মহরম পর্ব ০১ প্রবাহ
“তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব, সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অসংখ্য সৈন্যসামন্ত সকলই তোমার। দামেস্ক-রাজমুকুট অচিরে তোমারই শিরে শোভা পাইবে। তুমি এই রাজ্যের কোটি কোটি প্রজার অধীশ্বর হইয়া তাহাদিগকে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন এবং জাতীয় ধর্মের উৎকর্ষ সাধন করিয়া সর্বত্র পূজিত এবং সকলের আদৃত হইবে। বল তো তোমার কিসের অভাব? কী মনস্তাপ? আমি তো ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। তুমি সর্বদাই মলিন ভাবে বিষাদিত চিত্তে বিকৃতমনার ন্যায় অযথা চিন্তায় অযথাস্থানে ভ্রমণ করিয়া দিন দিন ক্ষীণ ও মলিন হইতেছ। সময়ে সময়ে যেন একেবারে বিষাদ-সিন্ধুতে নিমগ্ন হইয়া, জগতের সমুদয় আশা জলাঞ্জলি দিয়া আত্মবিনাশে প্রস্তুত হইতেছ; ইহারই-বা কারণ কী? আমি পিতা, আমার নিকটে কিছুই গোপন করিয়ো না। মনের কথা অকপটে প্রকাশ কর। যদি অর্থের আবশ্যক হইয়া থাকে, ধনভাণ্ডার কাহার জন্য? যদি রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া রাজ্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করিবার বাসনা হইয়া থাকে, বল, আমি এই মুহূর্তেই তোমাকে মহামূল্য রাজবেশে সুসজ্জিত করিয়া রাজমুকুট তোমার শিরে অর্পণ করাইতেছি, এখনই তোমাকে সিংহাসনে উপবেশন করাইতেছি। আমি স্বচক্ষে তোমাকে রাজকার্যে নিয়োজিত দেখিয়া নশ্বর বিশ্বসংসার পরিত্যাগ করিতে পারিলে তাহা অপেক্ষা ঐহিকের সুখ আর কী আছে? তুমি আমার একমাত্র পুত্ররত্ন। অধিক আর কী বলিব-তুমি আমার অন্ধের যষ্টি, নয়নের পুত্তলি, মস্তকের অমূল্য মণি, হৃদয়ভাণ্ডারের মহামূল্য রত্ন, জীবনের জীবনীশক্তি-আশাতরু অসময়ে মুঞ্জরিত, আশামুকুল অসময়ে মুকুলিত, আশা-কুসুম অসময়ে প্রস্ফুটিত। বাছা, সদাসর্বদা তোমার মলিন মুখ ও বিমর্ষ ভাব দেখিয়া আমি একেবারে হতাশ হইয়াছি, জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছি। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, মনের কথা অকপটে আমার নিকট প্রকাশ কর। আমি পিতা হইয়া মনের বেদনায় আজ তোমার হস্তধারণ করিয়া বলিতেছি সকল কথা মন খুলিয়া আমার নিকট কি জন্য প্রকাশ কর না?” মাবিয়া নির্জনে নির্বেদসহকারে এজিদ্কে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।
এজিদ্ দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক বলিতে অগ্রসর হইয়াও কোন কথা বলিতে পারিলেন না; কণ্ঠরোধ হইয়া জিহ্বায় জড়তা আসিল। মায়ার আসক্তির এমনি শক্তি যে, পিতার নিকট মনোগত ভাব প্রকাশ করিবার অবসর প্রাপ্ত হইয়াও মনোভাব প্রকাশ করিতে পারিলেন না; সাধ্যাতীত চেষ্টা করিয়াও মুক্তহৃদয়ে প্রকৃত মনের কথা পিতাকে বুঝাইতে পারিলেন না। যদিও বহু কষ্টে ‘জয়’ শব্দটি উচ্চারণ করিলেন, কিন্তু সে শব্দ মাবিয়ার কর্ণগোচর হইল না। কথা যেন নয়নজলেই ভাসিয়া গেল; ‘জয়’ শব্দটি কেবল জলমাত্রেই সার হইল। গণ্ডস্থল হইতে বক্ষঃস্থল পর্যন্ত বিষাদ-বারিতে সিক্ত হইতে লাগিল। সেই বিষাদ-বারিপ্রবাহ দর্শন করিয়া অনুতাপী মাবিয়া আরো অধিকতর দুঃখানলে দগ্ধীভূত হইতে লাগিলেন। জলে অগ্নি নির্বাণ হয়; কিন্তু প্রেমাগ্নি অন্তরে প্রজ্বলিত হইয়া প্রথমে নয়ন দুটির আশ্রয়ে বাষ্প সৃষ্টি করে, পরিণামে জলে পরিণত হইয়া স্রোত বহিতে থাকে। সে জলে হয়ত বাহ্যবহ্নি সহজেই নির্বাপিত হইতে পারে, কিন্তু মনের আগুন দ্বিগুণ, চতুর্গুণ, শতগুণ জ্বলিয়া উঠে। এজিদ রাজ্যের প্রয়াসী নহেন, সৈন্যসামন্ত এবং রাজমুকুটেরও প্রত্যাশী নহেন, রাজসিংহাসনের আকাঙ্খীও নহেন। তিনি যে রত্নের প্রয়াসী, তিনি যে মহামূল্য ধনের প্রত্যাশী, তাহা তাঁহার পিতার মনের অগোচর, বুদ্ধির অগোচর। পুত্রের ঈদৃশী অবস্থা দেখিয়া মাবিয়া যারপরনাই দুঃখিত ও চিন্তিত হইলেন। শেষে অশ্রুসম্বরণে অক্ষম হইয়া বাষ্পাকুললোচনে পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্! তোমার মনের কথা মন খুলিয়া আমার নিকট ব্যক্ত কর। অর্থে হউক বা সামর্থ্যে হউক, বুদ্ধি কৌশলে হউক, যে কোন প্রকারেই হউক, তোমার মনের আশা আমি পূর্ণ করিবই করিব। তুমি আমার যত্নের রত্ন, অদ্বিতীয় স্নেহাধার। তুমি পাগলের ন্যায় হতবুদ্ধি, অবিবেকের ন্যায় সংসার-বর্জিত হইয়া মাতা পিতাকে অসীম দুঃখসাগরে ভাসাইবে, বনে-বনে, পর্বতে পর্বতে বেড়াইয়া বেড়াইয়া অমূল্যজীবনকে তুচ্ছজ্ঞানে হয়ত কোন্ দিন আত্মঘাতী হইয়া এই কিশোর বয়সে মৃত্তিকাশায়ী হইবে, ইহা ভাবিয়া আমার প্রাণ নিতান্তই আকুল হইতেছে; কিছুতেই স্থির হইতে পারিতেছি না। জীবন যেন দেহ ছাড়িয়া যাই যাই করিতেছে, প্রাণপাখি যেন পিঞ্জর ছাড়িয়া উড়ি-উড়ি করিতেছে। বল দেখি বৎস! কোন্ চক্ষে মাবিয়া তোমার প্রাণশূন্য দেহ দেখিবে? বল দেখি বৎস! কোন্ প্রাণে মাবিয়া তোমার মৃতদেহে শেষ বসন (কাফন) পরাইয়া মৃত্তিকায় প্রোথিত করিবে?”
এজিদ্ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! আমার দুঃখ অনন্ত। এ দুঃখের সীমা নাই, উপশমের উপায় নাই। আমি নিরূপায় হইয়াই জগতে আশা হইতে একেবারে বহু দূরে দাঁড়াইয়া আছি। আমার বিষয়, বিভব, ধন, জন, মতা সমস্তই অতুল, তাহা আমি জানি। আমি অবোধ নই; কিন্তু আমার অন্তর যে মোহিনী-মূর্তির সুতীক্ষ্ণ নয়ন-বাণে বিদ্ধ হইতেছে, সে বেদনার উপশম নাই। পিতঃ! সে বেদনার প্রতিকারের প্রতিকার নাই। যদি থাকিত, তবে বলিতাম! আর বলিতে পারি না। এতদিন অতি গোপনে মনে মনে রাখিয়াছিলাম, আজ আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া মনের কথা যতদূর সাধ্য বলিলাম। আর বলিবার সাধ্য নাই। হয় দেখিবেন, না হয় শুনিবেন-এজিদ্ বিষপান করিয়া যেখানে শোকতাপের নাম নাই, প্রণয়ে হতাশ নাই, অভাব নাই এবং আশা নাই, এমন কোন নির্জন স্থানে এই পাপময় দেহ রাখিয়া সেই পবিত্রধামে চলিয়া গিয়াছে। আর অধিক বলিতে পারিতেছি না, ক্ষমা করিবেন।” এই কথা শেষ হইতে-না-হইতেই বৃদ্ধা মহিষী একগাছি সূবর্ণ-যষ্টি-আশ্রয়ে ঐ নির্জন গৃহমধ্যে আসিয়া এক পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলেন। এজিদ্ শশব্যস্তে উঠিয়া জননীর পদচুম্বন করিয়া পিতার পদধূলি গ্রহণান্তর সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। দামেস্কাধিপতি মহিষীকে অভ্যর্থনা করিয়া অতি যত্নে মসনদের (মসনদ পারস্য শব্দ। অনেকে যে মসলন্দ শব্দ ব্যবহার করেন, তাহা সম্পূর্ণ ভ্রম) পার্শ্বে বসাইয়া বলিতে লাগিলেন, “মহিষী! তোমার কথাক্রমে আজ বহু যত্ন করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারিলাম না; মনের কথা কিছুতেই ভাঙ্গিল না। পরিশেষে আপনিও কাঁদিল, আমাকেও কাঁদাইল। সে রাজ্যধনের ভিখারী নহে, বিনশ্বর ঐশ্বর্যের ভিখারী নহে; কেবল এইমাত্র বলিল যে, আমার আশা পূর্ণ হইবার নহে! আর শেষে যাহা বলিল তাহা মুখে আনা যায় না; বোধ হইতেছে যেন কোন মায়াবিনী মোহনীয় রূপে বিমুগ্ধ হইয়া এইরূপ মোহময়ী অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে।”
রাজমহিষী অতি কষ্টে মস্তক উত্তোলন করিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মহারাজ! আমি অনেক সন্ধানে জানিয়াছি, আর এজিদ্ও আপনার নিকটে আভাসে বলিয়াছে।-আবদুল জাব্বারকে বোধ হয় আপনি জানেন?”
মাবিয়া কহিলেন, “তাহাকে তো অনেক দিন হইতেই জানি।” “সেই আবদুল জাব্বারের স্ত্রীর নাম জয়নাব।”
“হাঁ হাঁ, ঠিক হইয়াছে। আমার সঙ্গে কথা কহিবার সময় ‘জয়’ পর্যন্ত বলিয়া আর বলিতে পারে নাই।” একটু অগ্রসর হইয়া মাবিয়া আবার কহিলেন, “হাঁ! সেই জয়নাব কি?”
“আমার মাথা আর মুণ্ডু! সেই জয়নাবকে দেখিয়াই তো এজিদ্ পাগল হইয়াছে। আমার নিকট কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, মা, যদি আমি জয়নাবকে না পাই, তবে আর আমাকে দেখিতে পাইবেন না। নিশ্চয় জানাজা (মৃত শরীরের সদ্গতির উপাসনা) ক্ষেত্রে কাফনবস্ত্রের তাবুতাসনে ধরাশায়ী দেখিবেন।” এই পর্যন্ত বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মহিষী পুনর্বার কহিলেন, “আমার এজিদ্ যদি না বাঁচিল, তবে আর এই জীবনে ও বৃথা ধনে ফল কি?”
যেন একটু সরোষে মাবিয়া কহিলেন, “মহিষী! তুমি আমাকে কী করিতে বল?”
“আমি কি করিতে বলিব? যাহাতে এজিদের প্রাণরক্ষা হয় তাহারই উপায় করুন। আপনি বর্তমান থাকিতে আমার সাধ্যই-বা কী-কথাই-বা কী?”
মাবিয়া রোষভরে উঠিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, বৃদ্ধা মহিষী হস্ত ধরিবামাত্র অমনি বসিয়া পড়িলেন। বলিতে লাগিলেন, “পাপী আর নারকীরা এ কার্যে যোগ দিবে। আমি ও-কথা আর শুনিতে চাই না। তুমি আর ও-কথা বলিয়া আমার কর্ণকে কলুষিত করিয়ো না। আপনার জিহ্বাকে ও পাপকথায় অপবিত্র করিয়ো না। ভাবিয়া দেখ দেখি, ধর্ম-পুস্তকের উপদেশ কি? পরস্ত্রীর প্রতি কুভাবে যে একবার দৃষ্টি করিবে, কোন প্রকার কুভাবের কথা মনোমধ্যে যে একবার উদিত করিবে, তাহারও প্রধান নরক ‘জাহান্নামে’ বাস হইবে। আর ইহকালের বিচার দেখিতে পাইতেছ! লৌহদণ্ড দ্বারা শত আঘাতে পরস্ত্রীহারীর অস্থি চূর্ণ, চর্ম ক্ষয় করিয়া জীবনান্ত করে। ইহা কী একবারও এজিদের মনে হয় না? প্রজার ধন, প্রাণ, মান, জাতি, এ সমুদয়ের রক্ষাকর্তা রাজা। রাজার কর্তব্যকর্মই তাহা। এই কর্তব্যে অবহেলা করিলে রাজাকে ঈশ্বরের নিকট দায়ী হইতে হয়। পরিণামে নরকের তেজোময় অগ্নিতে দগ্ধীভূত হইয়া ভস্মসাৎ হইতে হয়। তাহাতেও নিস্তার নাই। সে ভস্ম হইতে পুনরায় শরীর গঠিত হইয়া পুনরায় শাস্তিভোগ করিতে হয়। এমন গুরুপাপের অনুষ্ঠান করা দূরে থাকুক, শুনিতেও পাপ আছে। এজিদ্ আত্মবিনাশ করিতে চায়, করুক, তাহাতে দুঃখিত নহি। এমন শত এজিদ-শত কেন সহস্র এজিদ্ এই কারণে প্রাণত্যাগ করিলেও মাবিয়ার চক্ষে এক বিন্দু জল পড়া দূরে থাকুক বরং সন্তোষ-হৃদয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিবে। একটা পাপী জগৎ হইতে বহিষ্কৃত হইল বলিয়া ঈশ্বরের সমীপে এই মাবিয়া সেই জগৎপিতার নামে সহস্র সহস্র সাধুবাদ সমর্পণ করিবে। পুত্রের উপরোধে, কি তাহার প্রাণ রক্ষার কারণে ঈশ্বরের বাক্য-লঙ্ঘন করিয়া মাবিয়া কি মহাপাপী হইবে? তুমি কি তাহা মনে কর মহিষী? আমার প্রাণ থাকিতে তাহা হইবে না, মাবিয়া জগতে থাকিতে তাহা ঘটিবে না-কখনোই না।”
বৃদ্ধা মহিষী একটু অগ্রসর হইয়া মহারাজের হস্ত দৃঢ়রূপে ধারণ করিয়া কাতরভাবে বলিতে লাগিলেন, “দেখুন মহারাজ! এজিদ্ যে ফাঁদে পড়িয়াছে, সে ফাঁদে জগতের অনেক ভাল ভাল লোক বাঁধা পড়িয়াছেন। শত শত মুনি-ঋষি, ঈশ্বরভক্ত, কত শত মহাতেজস্বী জিতেন্দ্রিয় মহাশক্তিবিশিষ্ট মহাপুরুষ এই ফাঁদে পড়িয়া তত্ত্বজ্ঞান হারাইয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। আসক্তি, প্রেম ও ভালবাসার কথা ধর্মপুস্তকেও রহিয়াছে। ভাবিয়া দেখিলে প্রতীত হয়, মানুষের মধ্যেই ভালবাসার জন্ম, ইহা কাহাকেও শিক্ষা দিতে হয় না, দেখিয়াও কেহ শিক্ষা করে না, ভালবাসা স্বভাবতঃই জন্মে। বাদশানাম্দার! ইহাতে নূতন কিছুই নাই, আপনি যদি মনোযোগ করিয়া শুনেন, তবে আমি প্রণয় প্রসঙ্গ অনেক শুনাইতে পারি, দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইতেও পারি। জগতে শত শত ভালবাসার জন্ম হইয়াছে, অনেকেই ভালবাসিয়াছে, তাহাদের কীর্তিকলাপ আজ পর্যন্ত-আজ পর্যন্ত কেন, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্যন্ত মানবহৃদয়ে সমভাবে অঙ্কিত থাকিবে। বলিবেন, পাত্র বিবেচনা চাই। ভালবাসারূপ সমুদ্র যখন হৃদয়াকাশে মানস-চন্দ্রের আকর্ষণে স্ফীত হইয়া উঠে, তখন পাত্রাপাত্র জ্ঞান থাকে না। পিতা, মাতা, সংসার, ধর্ম, এমন কি ঈশ্বরকেও মনে থাকে কি না সন্দেহ। ইহাতে এজিদের দোষ কি বলুন দেখি? এই নৈসর্গিক কার্য নিবারণ করিতে এজিদের কি ক্ষমতা আছে? না আমার ক্ষমতা আছে? না আপনারই ক্ষমতা আছে? যাহাই বলুন মহারাজ! ভালবাসার ক্ষমতা অসীম!”
মাবিয়া বলিলেন, “আমি কি ভালবাসার দোষ দিতেছি? ভালবাসা তো ভাল কথা। মানব-শরীর ধারণ করিয়া যাহার হৃদয়ে ভালবাসা নাই, সে কি মানুষ? প্রেমশূন্য-হৃদয় কি হৃদয়? এজিদের ভালবাসা তো সেরূপ ভালবাসা নয়! তুমি কি কিছুই বুঝিতে পার নাই?”
মহিষী কহিলেন, “আমি বুঝিয়াছি, আপনিই বুঝিতে পারেন নাই। দেখুন মহারাজ! আমার এই অবস্থাতে ঈশ্বর সদয় হইয়া পুত্র দিয়াছেন। এ জগতে সংসারী মাত্রেই পুত্র কামনা করিয়া থাকে। বিষয়বিভব, ধন-সম্পত্তি অনেকেরই আছে; কিন্তু উপযুক্ত পুত্ররত্ন কাহার ভাগ্যে কয়টি ফলে বলুন দেখি? পুত্র-কামনায় লোকে কী না করে? ঈশ্বরের উপাসনা, ঈশ্বরভক্ত এবং ঈশ্বরপ্রেমিক লোকের অনুগ্রহের প্রত্যাশা, যথাসাধ্য দীন-দুঃখীর ভরণপোষণের সাহায্য প্রভৃতি যত প্রকার সৎকার্যে মনে আনন্দ জন্মে, সন্তান-কামনায় লোকে তাহা সকলই করিয়া থাকে। আপনি ঈশ্বরের নিকট কামনা করিয়া পুত্রধন লাভ করেন নাই; আমিও পুত্রলাভের জন্য বৃদ্ধ বয়সে ব বিদীর্ণ করিয়া শোণিতবিন্দু ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ করি নাই। দয়াময় ভগবানের প্রসাদে, অযাচিতভাবে এবং বিনাযত্নে আমরা উভয়ে এ পুত্ররত্ন লাভ করিয়াছি। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া ক্রোধ করিতে হয়। যে এজিদের মুখ, এক মুহূর্ত না দেখিলে একেবারে জ্ঞানশূন্য হন, এজিদ্কে সর্বদা নিকটে রাখিয়াও আপনার দেখিবার সাধ মিটে না, আমি তো সকলই জানি, কোন সময়ে এই এজিদ্কে প্রাণে মারিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহা পারিলেন কই? ঐ মুখ দেখিয়াই তো হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়াছিল। অস্ত্রাঘাতে পুত্রের প্রাণবধ-সঙ্কল্প সাধন করিবেন দূরে থাকুক, ক্রোড়ে লইয়া শত শতবার মুখচুম্বন করিয়াও মনের সাধ মিটাইতে পারেন নাই।”
মাবিয়া বলিলেন, “আমাকে তুমি কি করিতে বল?”
মহিষী বলিলেন, “আর কি করিতে বলিব। যাহাতে ধর্ম রক্ষা পায়, লোকের নিকটেও নিন্দনীয় না হইতে হয় অথচ এজিদের প্রাণরক্ষা পায়, এমন কোন উপায় অবলম্বন করাই উচিত।”
“উচিত বটে, কিন্তু উপায় আসিতেছে না। স্থূল কথা, যাহাতে ধর্ম রা পায়, ধর্মোপদেষ্টার আজ্ঞা লঙ্ঘন না হয় অথচ প্রাণাধিক পুত্রের প্রাণরক্ষা হয়, ইহা হইলেই যথেষ্ট হইল। লোকনিন্দার ভয় কী? যে মুখে লোকে একবার নিন্দা করে, সে মুখে সুখ্যাতির গুণগান করাইতে কতক্ষণ লাগে?”
মহিষী বলিলেন, “আপনাকে কিছুই করিতে হইবে না, কিছু বলিতেও হইবে না, কিন্তু কোন কার্যে বাধা দিতেও পারিবেন না। মারওয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াই আমি সকল কার্য করিব। ধর্মবিরুদ্ধ, ধর্মের অবমাননা কী ধর্মোপদেষ্টার আজ্ঞা লঙ্ঘনের অণুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতে পান, বাধা দিবেন, আমরা ক্ষান্ত হইব।”
মহারাজ মহাসন্তোষে মহিষীর হস্ত চুম্বন করিয়া বলিলেন, “তাহা যদি পার, তবে ইহা অপেক্ষা সন্তোষের বিষয় আর কী আছে? এজিদের অবস্থা দেখিয়াই আমার মনে যে কী কষ্ট হইতেছে, তাহা ঈশ্বরই জানেন। যদি সকল দিক্ রক্ষা করিয়া কার্য উদ্ধার করিতে পার, তবেই সর্বপ্রকারে মঙ্গল; এজিদ্ও প্রাণে বাঁচে, আমিও নিশ্চিন্তভাবে ঈশ্বর-উপাসনা করিতে পারি।”
শেষ কথাগুলি শ্রবণ করিয়া বৃদ্ধা মহিষী অনুকূলভাব-বিজ্ঞাপনসূচক মস্তক সঞ্চালন করিলেন। তখন তাহার মনে যে কি কথা, রসনা তাহা প্রকাশ করিল না; আকার-ইঙ্গিতে পতিবাক্যে সায় দিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। মৌন যেন কথা কহিল,-এই সঙ্কল্পই স্থির।
উদ্ধার পর্ব ০২ প্রবাহ
রে পথিক! রে পাষাণহৃদয় পথিক! কী লোভে এত ত্রস্তে দৌড়িতেছ? কী আশায় খণ্ডিত শির বর্শার অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছ? এ শিরে-হায়! এ খণ্ডিত শিরে তোমার প্রয়োজন কি? সীমার! এ শিরে তোমার আবশ্যক কি? হোসেন তোমার কী করিয়াছিল? তুমি তো আর জয়নাবের রূপে মোহিত হইয়াছিলে না? জয়নাব ইমাম হাসানের স্ত্রী। হোসেনের শির তোমার বর্শাগ্রে কেন? তুমিই-বা সে শির লইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে এত বেগে দৌড়াইতেছ কেন? যাইতেছই-বা কোথায়? সীমার! একটু দাঁড়াও। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়া যাও! কার সাধ্য তোমার গমনে বাধা দেয়? কার ক্ষমতা তোমাকে কিছু বলে? একটু দাঁড়াও। এ শিরে তোমার স্বার্থ কি? খণ্ডিত শিরে প্রয়োজন কি? অর্থ? হায় রে অর্থ! হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল। জীবের জীবনের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতা-পুত্রে শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নীতে কলহ, রাজা-প্রজায় বৈরীভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ। বিবাদ, বিসম্বাদ, কলহ, বিরহ, বিসর্জন, বিনাশ, এ সকল তোমার জন্য। সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি। তোমার কী মোহিনীশক্তি! কী মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম, রাজা, প্রজা, ধনী, নির্ধন, যুবক, বৃদ্ধ, সকলেই তোমার জন্য ব্যস্ত,-মহাব্যস্ত-প্রাণ ওষ্ঠাগত। তোমারই জন্য-কেবলমাত্র তোমারই কারণে-কত জনে তীর, তরবারি, বন্দুক, বর্শা, গোলাগুলি অকাতরে বক্ষ পাতিয়া বুকে ধরিতেছে। তোমারই জন্য অগাধ জলে ডুবিতেছে। ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করিতেছে, পর্বতশিখরে আরোহণ করিতেছে, রক্ত, মাংসপেশী, পরমাণু সংযোজিত শরীর! ছলনে! তোমারই জন্য শূন্যে উড়াইতেছে। কী কুহক! কী মায়া!! কী মোহিনীশক্তি!!! তোমার কুহকে কে না পড়িতেছে? কে না ধোঁকা খাইতেছে? কে না মজিতেছে? তুমি দূর হও, তুমি দূর হও! কবির কল্পনার পথ হইতে একেবারে দূর হও। কবির চিন্তাধারা হইতে একেবারে সরিয়া যাও! তোমার নাম করিয়া কথা কহিতে অঙ্গ শিহরিয়া উঠে! তোমারই জন্য প্রভু হোসেন সীমারহস্তে খণ্ডিত।-রাক্ষসী! তোমারই জন্য খণ্ডিত শির বর্শাগ্রে বিদ্ধ।
সীমার অবিশ্রান্ত যাইতেছে। দিনমণি মলিনমুখ, অস্তাচল গমনে উদ্যোগী। সীমারের অন্তরে নানা ভাব; তন্মধ্যে অর্থ-চিন্তাই প্রবল; চির-অভাবগুলি আশু মোচন করাই স্থির। একাই মারিয়াছি, একাই কাটিয়াছি, একাই যাইতেছি, একাই পাইব, আর ভাবনা কী? লক্ষ টাকার অধিকারীই আমি। চিন্তার কোন কারণই নাই। নিশাও প্রায় সমাগত। যাই কোথা? বিশ্রাম না করিলেও আর বাঁচি না। নিকটস্থ পল্লীতে কোন গৃহীর আবাসে যাইয়া নিশাযাপন করি। এ তো সকলই মহারাজ এজিদ্ নামদারের রাজ্যভুক্ত, অধীন ও অন্তর্গত। সৈনিক বেশ, হস্তে বর্শা, বর্শাগ্রে মনুষ্যশির বিদ্ধ, ভয়ানক রোষের লক্ষণ। কে কী বলিবে? কার সাধ্য-কে কী করিবে?
সীমার এক গৃহীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া ঐ স্থানে নিশাযাপন করিবেন জানাইলেন। বর্শাবিদ্ধ খণ্ডিত শির অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বুঝি রাজসংক্রান্ত কেহ-বা হয় মনে করিয়া গৃহস্বামী আর কোন কথা বলিলেন না। সাদরে সীমারকে স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন, পথশ্রান্তি দূরীকরণের উপকরণ আদি ও আহারীয় দ্রব্যসামগ্রী আনিয়া ভক্তিসহকারে আতিথ্য-সেবা করিলেন। ক্ষণকাল বিশ্রামের পর অতি বিনীতভাবে বলিলেন, “মহাশয়! যদি অনুমতি করেন, তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।”
সীমার বলিল- “কি কথা?”
“কথা আর কিছু নহে, আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন? আর এই বর্শা-বিদ্ধ-শির কোন্ মহাপুরুষের?”
“ইহার অনেক কথা। তবে তোমাকে অতি সংক্ষেপে বলিতেছি। মদিনার রাজা হোসেন, যাঁহার পিতা আলী এবং মোহাম্মদের কন্যা ফাতেমা যাঁহার জননী, এ তাঁহারই শির। কার্বালা প্রান্তরে, মহারাজ এজিদ্-প্রেরিত সৈন্য সহিত সমরে পরাস্ত হইয়া এই অবস্থা। দেহ হইতে মস্তক ভিন্ন করিয়া মহারাজের নিকট লইয়া যাইতেছি, পুরস্কার পাইব। লক্ষ টাকা পুরস্কার। তুমি পৌত্তলিক, তোমার গৃহে নানা দেবদেবীর প্রতিমূর্তি আছে দেখিয়াই আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছি। মোহাম্মদের শিষ্য হইলে কখনো তোমার গৃহে আসিতাম না। তোমার আদর-অভ্যর্থনাতেও ভুলিতাম না, তোমার আহারও গ্রহণ করিতাম না।”
“হাঁ, এতক্ষণে জানিলাম, আপনি কে? আর আপনার অনুমানও মিথ্যা নহে। আমি একেশ্বরবাদী নহি। নানা প্রকার দেব-দেবীই আমার উপাস্য। আপনি মহারাজ এজিদের প্রিয় সৈন্য, আমার অপরাধ গ্রহণ করিবেন না। স্বচ্ছন্দে বিশ্রাম করুন। কিন্তু বর্শা-বিদ্ধ-শির এ প্রকারে না রাখিয়া আমার নিকটে দিলে ভাল হইত। আমি আজ রাত্রে আপন তত্ত্বাবধানে রাখিতাম। প্রাতে আপনি যথা ইচ্ছা গমন করিতেন। কারণ যদি কোন শত্রু আপনার অনুসরণে আসিয়া থাকে, নিশীথ সময়ে কৌশলে কি বলপ্রয়োগে এই মহামূল্য শির আপনার নিকট হইতে কাড়িয়া লয়, কি আপনার ক্লান্তিজনিত অবশ অলসে, ঘোর নিদ্রায় অচেতন হইলে আপনার অজ্ঞাতে এই মহামূল্য শির,-আপাততঃ যাহার মূল্য লক্ষ টাকা-যদি কেহ লইয়া যায়, তবে মহাদুঃখের কারণ হইবে, আমাকে দিন, আমি সাবধানে রাখিব, আপনি প্রত্যূষে লইবেন। আমার তত্ত্বাবধানে রাখিলে আপনি নিশ্চিন্তভাবে নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারিবেন।”
সীমারের কর্ণে কথাগুলি বড়ই মিষ্ট বোধ হইল। আর দ্বিরুক্তি না করিয়া প্রস্তাব শ্রবণমাত্রেই সম্মত হইল। গৃহস্বামী হোসেন-মস্তক সম্মানের সহিত মস্তকে লইয়া বহুসমাদরে গৃহমধ্যে রাখিয়া দিল। পথশ্রান্তিহেতু সীমারের কেবল শয়ন বিলম্ব; যেমনই শয়ন অমনই অচেতন।
গৃহস্বামী বাস্তবিক হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার শিষ্য ছিলেন না। নানা প্রকার দেব-দেবীর আরাধনাতেই সর্বদা রত থাকিতেন। উপযুক্ত তিন পুত্র এবং এক স্ত্রী। নাম, “আজর।” (হজরত ইব্রাহিম খলিলুল্লার পিতার নামও আজর বোত্পরস্ত ছিল। ইনি সে আজর নহেন।)
সীমারের নিদ্রার ভাব জানিয়া, আজর স্ত্রীপুত্রসহ হোসেনের মস্তক ঘিরিয়া বসিলেন এবং আদ্যন্ত সমুদয় ঘটনা বলিলেন!
যে ঘটনায় পশুপক্ষীর চক্ষের জল ঝরিতেছে, প্রকৃতির অন্তর ফাটিয়া যাইতেছে, সেই দেহ-বিচ্ছিন্ন হোসেন-মস্তক দেখিয়া কাহার হৃদয়ে না আঘাত লাগে? দেব-দেবীর উপাসক হউন, ইসলাম ধর্মবিদ্বেষীই হউন, এ নিদারুণ দুঃখের কথা শুনিলে কে না ব্যথিত হউন? পিতাপুত্র সকলে একত্র হইয়া হোসেন-শোকে কাঁদিতে লাগিলেন।
আজর বলিলেন, “মনুষ্যমাত্রেই এক উপকরণে গঠিত এবং এক ঈশ্বরের সৃষ্ট। জাতিভেদ, ধর্মভেদ, সে-ও সর্বশক্তিমান ভগবানের লীলা। ইহাতে পরস্পর হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, কেবল মূঢ়তার লক্ষণ! ইমাম হাসান-হোসেনের প্রতি এজিদ্ যেরূপ অত্যাচার করিয়াছে, তাহা মনে করিলে হৃদয়মাত্রেরই তন্ত্রী ছিঁড়িয়া যায়। সে দুঃখের কথায় কোন্ চক্ষু না জলে পরিপূর্ণ হয়? মানুষের প্রতি এরূপ ঘোরতর অত্যাচার হউক আর না-হউক, জাতীয় জীবন বলিয়াও কী প্রাণে আঘাত লাগে না? সাধু পরম ধার্মিক, বিশেষ ঈশ্বরভক্ত, মহাপুরুষ মোহাম্মদের হৃদয়ের অংশ, ইঁহাদের এই দশা? হায়! হায়!! সামান্য পশু মারিলে কত মানুষ কাঁদিয়া গড়াগড়ি যায়-বেদনায় অস্থির হয়, আর মানুষের জন্য মানুষ কাঁদিবে না! ধর্মের বিভেদ বলিয়া, মানুষের বিয়োগে মানুষ মনোবেদনায় বেদনা বোধ করিবে না? যন্ত্রণা অনুভব করিবে না? যে ধর্মই কেন হউক না, পবিত্রতা রক্ষা করিতে, তৎকার্যে যোগ দিতে কে নিবারণ করিবে? মহাপুরুষ মোহাম্মদ পবিত্র, হাসান পবিত্র, হোসেনের মস্তক পবিত্র, সেই পবিত্র মস্তকের এত অবমাননা? যুদ্ধে হত হইয়াছে বলিয়াই কী এত তাচ্ছিল্য? জগৎ কয় দিনের? এজিদ্! তুই কী জগতে অমর হইয়াছিস্? জীবনশূন্য দেহের সদ্গগতির সংবাদ শুনিয়া কী তোর চির-জ্বলন্ত রোষাগ্নি নির্বাণ হইত না? তোর আকাক্সক্ষা কি যুদ্ধ-জয়ের সংবাদ শুনিয়া মিটিত না? হোসেনপরিবারের মহা ক্রন্দনের রোল সপ্ততল আকাশ ভেদ করিয়া অনন্তধামে অনন্তরূপে প্রবেশ করিয়া অনন্ত শোক বিকাশ করিতেছে! ঈশ্বরের আসন টলিতেছে!-তোর মন কী এতই কঠিন যে জীবনশূন্য শরীরে শত্রুতা সাধন করিতে ত্রুটি করিতেছিস্ না! তোকে কোন্ ঈশ্বর গড়িয়াছিল জানি না; কী উপকরণে তোর শরীর গঠিত, তাহাও বলিতে পারি না। তুই সামান্য লোভের বশবর্তী হইয়া কী কাণ্ড করিলি! তোর এই অমানুষিক কীর্তিতে জগৎ কাঁদিবে, পাষাণ গলিবে! এই মহাপুরুষ জীবিত থাকিলে এই মুখে কত শত প্রকারে ঈশ্বরের গুণ-কীর্তন-কত কাল ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রকাশ হইত, তাহার কী ইয়ত্তা আছে? তুই অসময়ে মহাঋষি হোসেনের প্রাণহরণ করিয়াছিস্, কিন্তু তোর পিতা ইমাম বংশের ভিন্ন নহেন; তাঁহার হৃদয় এমন কঠিন প্রস্তরে গঠিত ছিল না! তাঁহার ঔরসে জন্মিয়া তোর এ কি ভাব? রক্ত, মাংস, বীর্যগুণ আজ তোর নিকট পরাস্ত হইল। মানব শরীরের স্বাভাবিক গুণ আজ বিপরীত ভাব ধারণ করিল। তাই যাহাই হউক, আজরের এই প্রতিজ্ঞা-জীবন থাকিতে হোসেন-শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিবে না; যত্নের সহিত, আদরের সহিত, ভক্তিসহকারে সে মহাপ্রান্তর কারবালায় লইয়া যাইয়া, শিরশূন্য দেহের সন্ধান করিয়া সদ্গগতির উপায় করিবে; প্রাণ থাকিতে এ শির আজর ছাড়িবে না।”
আজরের স্ত্রী বলিলেন, “এই হোসেন, বিবি ফাতেমার অঞ্চলের নিধি, নয়নের পুত্তলি ছিলেন। হায়! হায়! তাঁহার এই দশা! এ জীবন থাক্ বা যাক্, প্রভাত হইতে-না-হইতে আমরা এই পবিত্র মস্তক লইয়া কার্বালায় যাইব। শেষে ভাগ্যে যা থাকে হইবে?”
পুত্রেরা বলিল, “আমাদের জীবন পণ, তথাপি কিছুতেই সৈনিকহস্তে এ মস্তক প্রত্যর্পণ করিব না। প্রাতে সৈনিককে বিদায় করিয়া সকলে একত্রে কার্বালায় যাইব।”
পুনরায় আজর বলিতে লাগিলেন, “ধার্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক। ধর্ম কী কখনো দুই হইতে পারে? সম্বন্ধ নাই, আত্মীয়তা নাই, কথায় বলে-রক্তে রক্তে লেশমাত্রও যোগাযোগ নাই, তবে তাহার দুঃখে তোমাদের প্রাণে আঘাত লাগিল কেন? বল দেখি, তাঁহার জন্য জীবন উৎসর্গ করিলে কেন? ধার্মিক-জীবন কাহার না আদরের? ঈশ্বর-প্রেমিক কাহার-না যত্নের? তোমাদের কথা শুনিয়া, সাহস দেখিয়া, প্রাণ শীতল হইল। পরোপকারব্রতে জীবনপণ কথাটা শুনিয়াও কর্ণ জুড়াইল। তোমাদের সাহসেই গৃহে থাকিলাম। প্রাণ দিব, কিন্তু শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিব না।”
পরস্পর সকলেই হোসেনের প্রসঙ্গ লইয়া রজনী অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্বালা প্রান্তরে যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা জগৎ দেখিয়াছে। নিশাদেবী জগৎকে আবার নূতন ঘটনা দেখাইতে, জগৎ-লোচন রবিদেবকে পূর্ব গগন-প্রান্তে বসাইয়া নিজে অন্তর্ধান হইবার উদ্যোগ করিতেছেন। জগৎ কল্য দেখিয়াছে, আজ আবার দেখুক-নিঃস্বার্থ প্রেমের আদর্শ দেখুক-পবিত্র জীবনের যথার্থ প্রণয়ী দেখুক-সাধু-জীবনের ভক্তি দেখুক-ধর্মে দ্বেষ, ধর্মে হিংসা, মানুষের শরীরে আছে কি-না, তাহার দৃষ্টান্ত দেখুক-ভ্রাতা, ভগিনী, পুত্র, জায়া, পরিজন বিয়োগ হইলে লোকে কাঁদিতে থাকে, জীবনকে অতি তুচ্ছজ্ঞানে, জীবন থাকিতেই জীবলীলা ইতি করিতে ইচ্ছা করে। পরের জন্য যে কাঁদিতে হয় না, প্রাণ দিতে হয় না, তাহারও জ্বলন্ত প্রমাণ আজ দেখুক, শিক্ষা করুক। সহানুভূতি কাহাকে বলে? মানুষের পরিচয় কী? মহাশক্তিসম্পন্ন হৃদয়ের ক্ষমতা কী? নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর কী? আজ ভাল করিয়া দেখুক।
জগৎ জাগিল। পূর্বগগন লোহিত রেখায় পরিশোভিত হইল। সীমার শয্যা হইতে উঠিয়া প্রাতঃক্রিয়াদি সমাপন করিল। সজ্জিত হইয়া বর্শাহস্তে দণ্ডায়মান-এবং উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “ও হে! আমি আর বিলম্ব করিতে পারিব না। আমার রক্ষিত মস্তক আনিয়া দাও, শীঘ্র যাইব।”
আজর বহির্ভাগে আসিয়া বলিলেন, “ভ্রাতঃ! তোমার নামটি কি শুনিতে চাই। আর তুমি কোন্ ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব তাহাও জানিতে চাই। ভাই, রাগ করিয়ো না; ধর্মনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, অর্থনীতি, যুক্তি, বিধি-ব্যবস্থা ইহার কিছুতেই এ-কথা পাওয়া যায় না যে, শত্রুর মৃতশরীরেও শত্রুতা সাধন করিতে হয়। বন্য পশু এবং অসভ্য জাতিরাই গতজীবন শত্রু-শরীরে নানাপ্রকার লাঞ্ছনা দিয়া মনে মনে আনন্দ অনুভব করে। ভ্রাতঃ! তোমার রাজা সুসভ্য, তুমিও দিব্য সভ্য; এ অবস্থায় এ পশু-আচার কেন, ভাই?”
“রাত্রে আমাকে আশ্রয় দিয়াছ, তোমার প্রদত্ত অন্নে উদর পরিপূর্ণ করিয়াছি, সুতরাং সীমারের বর্শা হইতে রক্ষা পাইলে। সাবধান! ও-সকল হিতোপদেশ আর কখনো মুখে আনিয়ো না। তোমার হিতোপদেশ তোমার মনেই থাকুক। ভাই সাহেব! বিড়ালতপস্বী, কপট ঋষি, ভণ্ড গুরু, স্বার্থপর পীর, লোভী মৌলবী জগতে অনেক আছে,-অনেক দেখিয়াছি,-আজও দেখিলাম। তোমার ধর্ম-কাহিনী, তোমার রাজনৈতিক উপদেশ, তোমার যুক্তি, কারণ, বিধি-ব্যবস্থা সমুদয় তুলিয়া রাখ। ধর্মাবতারের ধূর্ততা, চতুরতা সীমারের বুঝিতে আর বাকী নাই; ও-কথায় মহাবীর সীমার ভুলিবে না। আর এ মোটা কথাটা কে না বুঝিবে যে, হোসেনের মস্তক তোমার নিকট রাখিয়া যাই, আর তুমি দামেস্কে যাইয়া মহারাজের নিকট বাহাদুরি জানাইয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার লাভ কর। যদি ভাল চাও, যদি প্রাণ বাঁচাইতে ইচ্ছা কর, যদি কিছুদিন জগতের মুখ দেখিতে বাসনা হয়, তবে শীঘ্র হোসেনের মাথা আনিয়া দাও।”
“ওরে ভাই! আমি তোমার মত স্বার্থপর অর্থলোভী নহি। আমি দেবতার নাম করিয়া বলিতেছি, অর্থলালসায় হোসেন-মস্তক কখনোই দামেস্কে লইয়া যাইব না। টাকা অতি তুচ্ছ পদার্থ, উচ্চহৃদয়ে টাকার ঘাত-প্রতিঘাত নাই। দয়া, দাক্ষিণ্য, ধর্ম, সুনাম, যশঃকীর্তি, পরদুঃখে কাতরতা, এই সকল মহামূল্য রত্নের নিকট টাকার মূল্য কি রে ভাই!”
“ওহে ধার্মিকবর! আমি ও-সকল কথা অনেক জানি। টাকা যে জিনিস, তাহাও ভাল করিয়া চিনি। মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন; কিন্তু জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই, সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই, ভ্রাতা ভগ্নীর নিকট কথাটার প্রত্যাশা নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালবাসে, বল তো জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা নাই; কাহারো নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা। জগতে টাকারই খেলা। টাকা যে কি পদার্থ, তাহা তুমি চেন বা না-চেন, আমি বেশ চিনি। আর তুমি নিশ্চয় জানিয়ো, আমি নেহাত মূর্খ নহি, আপন লাভালাভ বেশ বুঝিতে পারি। যদি ভাল চাও, যদি আপন প্রাণ বাঁচাইতে চাও, তবে শীঘ্র খণ্ডিত মস্তক আনিয়া দাও! রাজদ্রোহীর শাস্তি কি?-ওরে পাগল! রাজদ্রোহীর শাস্তি কি, তাহা জান?”
“রাজ-বিদ্রোহীর শাস্তি আমি বিশেষরূপে জানি। দেখ ভাই! তোমার সহিত বাদ-বিসম্বাদ ও কৌশল করিতে আমার ইচ্ছামাত্র নাই। তুমি মহারাজ এজিদের সৈনিক, আমি তাঁহার অধীনস্থ প্রজা, সাধ্য কি রাজকর্মচারীর আদেশ অবহেলা করি! একটু অপেক্ষা কর, খণ্ডিত শির আনিয়া দিতেছি, মস্তক পাইলেই তো ভাই তুমি ক্ষান্ত হও?”
“হাঁ, মস্তক পাইলেই আমি চলিয়া যাই, ক্ষণকালও এখানে থাকি না।-আর ইহাও বলিতেছি-মহারাজের নিকট তোমার ভাল কথাই বলিব। আমাকে আদর-আহ্লাদে স্থান দিয়াছ, অভ্যর্থনা করিয়াছ, সকলই বলিব। হয়তো ঘরে বসিয়া কিছু পুরস্কারও পাইতে পার। শীঘ্র শির আনিয়া দাও।”
আজর স্ত্রীপুত্রগণের নিকট যাইয়া বিষন্নভাবে বলিলেন, “হোসেনের মস্তক রাখিতে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, তাহা বুঝি ঘটিল না। মস্তক না লইয়া সৈনিক-পুরুষ কিছুতেই যাইতে চাহে না; আমি তোমাদের সহায়ে সৈনিক-পুরুষের ইহকালের মত লক্ষ টাকা প্রাপ্তির আশা এই স্থান হইতে মিটাইয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু আমি স্বয়ং যাচ্ঞা করিয়া হোসেনের মস্তক আপন তত্ত্বাবধানে রাখিয়াছি; আবার সেও বিশ্বাস করিয়া আমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছে; এ অবস্থায় উহার প্রাণবধ করিলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার সহিত নরহত্যা পাপপঙ্কিলে ডুবিতে হয়। রাজঅনুচর, রাজকর্মচারী, রাজাশ্রিত লোককে, প্রজা হইয়া প্রাণে মারা, সে-ও মহাপাপ। আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, নিজ মস্তক স্কন্ধোপরি রাখিয়া হোসেনের মস্তক সৈনিকহস্তে কখনোই দিব না। তোমরা ঐ খড়্গ দ্বারা আমার মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সৈনিকের হস্তে দাও, সে বর্শায় বিদ্ধ করুক। খণ্ডিত শির প্রাপ্ত হইলে তিলার্ধ কালও এখানে থাকিবে না বলিয়াছে। তোমরা যত্নের সহিত হোসেনের মস্তক কারবালায় লইয়া, দেহ সন্ধান করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদ্যোগ করিবে, এই আমার শেষ উপদেশ। সাবধান, কেহ ইহার অন্যথা করিয়ো না!”
আজরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সায়াদ বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! আমরা ভ্রাতৃদ্বয় বর্তমান থাকিতে আপনার মস্তক দেহ-বিচ্ছিন্ন হইবে? এ কী কথা! আমরা কি পিতার উপযুক্ত পুত্র নহি? আমাদের অন্তরে কি পিতৃভক্তির কণামাত্রও স্থান পায় নাই! আমরা কি এমনই নরাকার পশু যে স্বহস্তে পিতৃমস্তক ছেদন করিব? ধিক্ আমাদের জীবনে! ধিক্ আমাদের মনুষ্যত্বে! যে পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া জগতের মুখ দেখিয়াছি; মানুষের পরিচয়ে মানুষের সহিত মিশিয়াছি, সেই পিতার শির যে-কারণে দেহ বিচ্ছিন্ন হইবে সে-কারণের উপকরণ কি আমরা হইতে পারিব না? পিতঃ! আর বিলম্ব করিবেন না, খণ্ডিত-মস্তক প্রাপ্ত হইলেই যদি সৈনিক-পুরুষ চলিয়া যায়, তবে আমার মস্তক লইয়া তাহার হস্তে প্রদান করুন। সকল গোল মিটিয়া যাউক।”
“ধন্য সায়াদ! তুমি ধন্য! জগতে তুমিই ধন্য! পরোপকারব্রতে তুমিই যথার্থ দীক্ষিত! তোমার জন্ম সার্থক। আমারও জীবন সার্থক। যে উদরে জন্মিয়াছ, সে উদরও সার্থক প্রাণাধিক! জগতে জন্মিয়া পশুপক্ষীদিগের ন্যায় নিজ উদর পরিপোষণ করিয়া চলিয়া গেলে মনুষ্যত্ব কোথায় থাকে?” ইহা বলিয়াই আজর দোলায়মান খড়্গ টানিয়া লইয়া হস্ত উত্তোলন করিলেন।
পরের জন্য-বিশেষ খণ্ডিত মস্তকের জন্য-আজর, হৃদয়ের হৃদয়-আত্মার আত্মা, প্রাণের প্রাণ জ্যেষ্ঠ পুত্রের গ্রীবা লক্ষ্যে খড়্গ উত্তোলন করিলেন। পিতার হস্ত উত্তোলনের ইঙ্গিত দেখিয়া সায়াদ গ্রীবা নত করিলেন, আজরের স্ত্রী চক্ষু মুদিত করিলেন। কবির কল্পনা-আঁখি ধাঁধা লাগিল, বন্ধ হইল। সুতরাং কি ঘটিল, কি হইল, লেখনী তাহা প্রকাশ করিতে পারিল না!
উঃ! কী সাহস! কী সহ্যগুণ! দেখ রে! পাষণ্ড এজিদ! হৃদয় দেখ। পরোপকারব্রতে পিতার হস্তে সন্তানের বধ দেখ্! দেখ রে সীমার! তুইও দেখ! মনুষ্যজীবনের ব্যবহার দেখ! খড়্গ কম্পিত হইল, রঞ্জিত হইল, পরোপকার আর মৃতশিরের সৎকারহেতু প্রাণাধিক পুত্রশোণিতে আজ পিতার হস্ত রঞ্জিত হইল, লৌহ-নির্মিত খড়্গ কাঁপিয়া স্বাভাবিক ঝন্ঝন্ রবে আর্তনাদ করিয়া উঠিল, কিন্তু আজরের রক্ত-মাংসের শরীর হেলিল না, শিহরিল না-মুখমণ্ডল মলিন হইল না! ধন্য রে পরোপকার! ধন্য রে হৃদয়!!
এদিকে সীমার বর্শাহস্তে বহির্ভাগে দণ্ডায়মান হইয়া মহাচিৎকার করিয়া বলিতেছে, “খণ্ডিত শির হস্তে না করিয়া যে আমার সম্মুখে আসিবে, তাহার মস্তক ধুলায় লুণ্ঠিত হইবে, অথচ হোসেনের মস্তক লইয়া যাইব।”
আজর খণ্ডিত শির হস্তে করিয়া সীমার সম্মুখে উপস্থিত হইলে সীমার মহাহর্ষে শির বর্শায় বিদ্ধ করিতে যাইয়া দেখিল যে, সদ্যকর্তিত শোণিত রঞ্জিত রক্তধারা বহিয়া পড়িতেছে। আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিল, “এ কী? তুমি উন্মাদ হইয়া এ কী করিলে? এ মস্তক লইয়া আমি কী করিব? লক্ষ টাকা প্রাপ্ত আশয়ে হোসেন-মস্তক গোপন করিয়া কাহাকে বধ করিলে? তোমার মত নরপিশাচ অর্থলোভী তো আমি কখনো দেখি নাই! আহা এই বুঝি তোমার হিতোপদেশ! এই বুঝি তোমার পরোপকারব্রত! ওরে নরাধম! এই বুঝি তোমার সাধুতা? কী প্রবঞ্চক! কী পাষণ্ড! ওরে নরপিশাচ আমাকে ঠকাইতে আসিয়াছিস?”
“ভ্রাতঃ! আমি ঠকাইতে আসি নাই। তুমিই তো বলিয়াছ যে, খণ্ডিত মস্তক পাইলেই চলিয়া যাইবে। এখন এ কী কথা-এক মুখে দুই কথা কেন ভাই?”
“আমি কি জানি যে তুমি একজন প্রধান দস্যু! টাকার লোভে কাহার কী সর্বনাশ করিবে কে জানে?”
“তুমি কি পুণ্যফলে হোসেন-মস্তক কাটিয়াছিলে ভাই? মস্তক পাইলেই চলিয়া যাইবে-কথা ছিল, এখন বিলম্ব কেন? আমার কথা আমি রক্ষা করিলাম; এখন তোমার কথা তুমি ঠিক রাখ।”
“কথা কাটিলে চলিবে না। যে মস্তকের জন্য র্কাবালা প্রান্তরে রক্তের স্রোত বহিয়াছে, যে মস্তকের জন্য মহারাজ এজিদ্ ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিয়াছেন, যে মস্তকের জন্য চতুর্দিকে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ রব হইতেছে, সেই মস্তকের পরিবর্তে এ কী?-ইহাতে আমার কী লাভ হইবে? তুমি আমার প্রদত্ত মস্তক আনিয়া দাও।”
“ভাই! তুমি তোমার কথা ঠিক রাখিলে না, ইহাই আমার দুঃখ। মানুষের এমন ধর্ম নহে।”
সীমার মহা গোলযোগে পড়িল। একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “এ শির এখানেই রাখিয়া দাও, আমি খণ্ডিত মস্তক পাইলেই চলিয়া যাইব, পুনরায় প্রতিজ্ঞা করিলাম। আন দেখি, এবারে হোসেন-শির না আনিয়া আর কি আনিবে? আন দেখি!”
আজরের মুখভাব দেখিয়াই মধ্যম পুত্র বলিলেন, “পিতঃ! চিন্তা কী? আমরা সকলেই শুনিয়াছি, খণ্ডিত-মস্তক পাইলেই সৈনিকপ্রবর চলিয়া যাইবেন। অধম সন্তান এই দণ্ডায়মান হইল, খড়্গ হস্তে করুন, আমরা বাঁচিয়া থাকিতে মহাপুরুষ হোসেনের শির দামেস্করাজের ক্রীড়ার জন্য লইয়া যাইতে দিব না।”
আজর পুনরায় খড়্গ হস্তে লইলেন, যাহা হইবার হইয়া গেল। শির লইয়া সীমারের নিকট আসিলে সীমার আরো আশ্চর্যান্বিত হইয়া মনে মনে বলিল, “এ উন্মাদ কী করিতেছে!” প্রকাশ্যে বলিল, “ওহে পাগল! তোমার এ পাগলামি কেন? আমি হোসেনের শির চাহিতেছি।”
“এ কী কথা! ভ্রাতঃ! তোমার একটি কথাতেও বিশ্বাসের লেশ নাই! ধিক্ তোমাকে!”
পুনরায় সীমার বলিল, “দেখ ভাই! তুমি হোসেনের শির রাখিয়া কি করিবে? এক মস্তকের পরিবর্তে দুইটি প্রাণ অনর্থক বিনাশ করিলে, বল তো ইহারা তোমার কে?”
“এ দুইটি আমার সন্তান।”
“তবে তো তুই বড় ধূর্ত ডাকাত। টাকার লোভে আপনার সন্তান স্বহস্তে বিনাশ করিতেছ! ছি ছি! তোমার ন্যায় অর্থপিশাচ জগতে আর কে আছে? তুমি তোমার পুত্রের মস্তক ঘরে রাখিয়া দাও, শীঘ্র হোসেনের মস্তক আনয়ন কর, নতুবা তোমার নিস্তার নাই।”
“ভ্রাতঃ! আমার গৃহে একটি মস্তক ব্যতীত আর নাই, আনিয়া দিতেছি, লইয়া যাও।”
“আরে হাঁ হাঁ, সেইটিই চাহিতেছি; সেই একটি মস্তক আনিয়া দিলেই আমি এখনই চলিয়া যাই।”
আজর শীঘ্র শীঘ্র যাইয়া যাহা করিলেন, তাহা লেখনীতে লেখা অসাধ্য। পাঠক! বোধ হয় বুঝিয়া থাকিবেন। এবারে সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের শির লইয়া আজর সীমারের নিকট উপস্থিত হইলেন।
সীমার ক্রোধে অধীর হইয়া বলিতে লাগিল, “আমি এতক্ষণ অনেক সহ্য করিয়াছি। পিশাচ! আমার সঞ্চিত শির লইয়া তুই পুরস্কার লইবি? তাহা কখনোই পরিবি না!”
“আমি পুরস্কার চাহি না। আমার লক্ষ লক্ষ বা লক্ষাধিক লক্ষ মূল্যের তিনটি মস্তক তোমাকে দিয়াছি। ভাই! তবু তুমি এখান হইতে যাইবে না?”
“ওরে পিশাচ! টাকার লোভ কে সম্বরণ করিতে পারে? হোসেনের শির তুই কী জন্য রাখিয়াছিস্? তোর সকলই কপট। শীঘ্র হোসেনের মস্তক আনিয়া দে!”
“আমি হোসেনের মস্তক তোমাকে দিব না। এক মস্তকের পরিবর্তে তিনটি দিয়াছি, আর দিব না,-তুমি চলিয়া যাও।”
সীমার ক্রোধে অধীর হইয়া বলিল, “তুই মনে করিস্ না যে হোসেন-মস্তক মহারাজ এজিদের নিকট লইয়া যাইয়া পুরস্কার লাভ করিবি। এই যা, একেবারে দামেস্কে চলিয়া যা!” সীমার সজোরে আজরের বক্ষে বর্শাঘাত করিয়া ভূতলশায়ী করিল এবং বীরদর্পে আজরের শয়ন গৃহের দ্বারে যাইয়া দেখিল, সুবর্ণ পাত্রোপরি হোসেনের মস্তক স্থাপিত রহিয়াছে, আজরের স্ত্রী খড়্গহস্তে তাহা রক্ষা করিতেছেন। সীমার এক লম্ফে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া হোসেনের মস্তক পূর্ববৎ বর্শাবিদ্ধ করিয়া আজরের স্ত্রীকে বলিল, “তোকে মারিব না, ভয় নাই সীমার-হস্ত কখনোই স্ত্রী-বধে উত্তোলিত হয় নাই; কোন ভয় নাই।”
আজরের স্ত্রী বলিলেন, “আমার আবার ভয় কি! যাহা হইবার হইয়া গেল। এই পবিত্র মস্তক রক্ষার জন্য আজ সর্বহারা হইলাম, আর ভয় কি? মনের আশা পূর্ণ হইল না-হোসেনের শির কারবালায় লইয়া যাইয়া সৎকার করিতে পারিলাম না, ইহাই দুঃখ। তোমাকে আমার কিছুই ভয় নাই। আমাকে তুমি কি অভয় দান করিবে?”
“কি অভয় দান করিব? তোকে রাখিলে রাখিতে পারি, মারিলে এখনই মারিয়া ফেলিতে পারি।”
“আমার কি জীবন আছে? আমি তো মরিয়াই আছি। তোমার অনুগ্রহ আমি কখনোই চাহি না।”
“তুই আমার অনুগ্রহ চাহিস না? সীমারের অনুগ্রহ চাহিস না? আরে পাপিয়সী! তুই স্বচক্ষেই তো দেখিলি, তোর স্বামীকে কি করিয়া মারিয়া ফেলিলাম। তুই স্ত্রীলোক হইয়া আমার অনুগ্রহ চাহিস না?”
এই বলিয়া সীমার বর্শাহস্তে আজরের স্ত্রীর দিকে যাইতেই, আজরের স্ত্রী খড়্গহস্তে রোষভরে দাঁড়াইয়া বলিলেন, “দেখিতেছিস! ওরে পাপিষ্ঠ নরাধম, দেখিতেছিস্? তিনটি পুত্রের রক্তে আজ এই খড়্গ রঞ্জিত করিয়াছি; পরপর আঘাতে স্পষ্টতঃ তিনটি রেখা দেখা যাইতেছে। পামর! নিকটে আয়, চতুর্থ রেখা তোর দ্বারা পূর্ণ করি।”
সীমার একটু সরিয়া দাঁড়াইল। আজরের স্ত্রী বলিল, “ভয় নাই, তোকে মারিয়া আমি কি করিব। আমার বাঁচিয়া থাকা আর না-থাকা সমান কথা। তবে দেখিতেছি, এই খড়্গে তিন পুত্র গিয়াছে, আর ঐ বর্শাতে তুই আমার জীবন-সর্বস্ব পতির প্রাণ বিনাশ করিয়াছিস্।” এই কথা বলিতে বলিতে আজর-স্ত্রী সীমারের মস্তক লক্ষ্য করিয়া খড়্গাঘাত করিলেন। সীমারের হস্তস্থিত বর্শায় বাধা লাগিয়া দক্ষিণ হস্তে আঘাত লাগিল। বর্শাবিদ্ধহোসেন মস্তক বর্শাচ্যুত হইয়া মৃত্তিকায় পতিত হইবামাত্র আজর-স্ত্রী ক্রোড়ে করিয়া বেগে পলাইতে লাগিলেন; কিন্তু সীমার বামহস্তে সাধ্বী সতীর বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া সজোরে ক্রোড় হইতে হোসেন-শির কাড়িয়া লইল। আজরের স্ত্রী তখন একেবারে হতাশ হইয়া নিকটস্থ খড়্গ দ্বারা আত্মবিসর্জন করিলেন, সীমারের বর্শাঘাতে মরিতে হইল না। সীমার হোসেন-শির পূর্ববৎ বর্শায় বিদ্ধ করিয়া দামেস্কাভিমুখে চলিল।
উদ্ধার পর্ব ০৩ প্রবাহ
সময়ে সকলই সহ্য হয়। কোন বিষয়ে অনভ্যাস থাকিলে বিপদকালে তাহার অভ্যাস হইয়া পড়ে, মহা সুখের শরীরেও মহা কষ্ট সহ্য হইয়া থাকে-এ কথার মর্ম হঠাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারিবেন। পরাধীন জীবনে সুখের আশা করাই বৃথা। বন্দি অবস্থায় ভাল-মন্দ সুখ-দুঃখ বিবেচনা করাও নিষ্ফল। চতুর্দিকে নিষ্কোষিত অসি, ত্বরিৎগতি বিদ্যুতের ন্যায় বর্শাফলক, সময়ে সময়ে চক্ষে ধাঁধা দিতেছে। বন্দিগণ মলিনমুখ হইয়া দামেস্কে যাইতেছে, কাহার ভাগ্যে কি আছে কে বলিতে পারে! সকলেরই একমাত্র চিন্তা জয়নাল আবেদীন। এজিদ্ সকলের মস্তক লইয়াও যদি জয়নালের প্রতি দয়া করে, তাহা হইলেও সহস্র লাভ। দামেস্ক নগরের নিকটবর্তী হইলেই, সকলেই এজিদ-ভবনে আনন্দধ্বনি শুনিতে পাইলেন। সীমার হোসেনের শির লইয়া পূর্বেই আসিয়াছে, কাজেই আনন্দের লহরী ছুটিয়াছে, নগরবাসী উৎসবে মাতিয়াছে। মহারাজ এজিদের জয়, দামেস্করাজের জয়-ঘোষণা মুহূর্তে মুহূর্তে ঘোষিত হইতেছে। নানা বর্ণে রঞ্জিত পতাকারাজি উচ্চ উচ্চ মঞ্চে উড্ডীয়মান হইয়া মহাসংগ্রামের বিজয় ঘোষণা করিতেছে। আজ এজিদ্ আনন্দসাগরে সন্তোষ-তরঙ্গে সভাসদ্গণ সহিত মনপ্রাণ ভাসাইয়া দিয়াছেন। বন্দিগণ রাজপ্রাসাদে আনীত হইল, দ্বিগুণরূপে আনন্দ-বাজনা বাজিয়া উঠিল। এজিদ্ যুদ্ধবিজয়ী সৈন্যদিগকে আশার অতিরিক্ত পুরস্কৃত করিলেন। শেষে মনের উল্লাসে ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিলেন। অবারিত দ্বার,-যাহার যত ইচ্ছা লইয়া মনের উল্লাসে রাজাদেশে আমোদ-আহ্লাদে প্রবৃত্ত হইল। অনেকেই আমোদে মাতিল।
হাসনেবানু, সাহারবানু, জয়নাব, বিবি ফাতেমা (হোসেনের অল্পবয়স্কা কন্যা), এবং বিবি ওম্মে সালেমা (ওম্মে সালেমা হজরত মোহাম্মদের ষষ্ঠ স্ত্রী) প্রভৃতিকে দেখিয়া এজিদ্ মহাহর্ষে হাসি হাসি মুখে বলিতে লাগিলেন, “বিবি জয়নাব! এখন আর কার বল বলুন? বিধবা হইয়াও হোসেনের বলে এজিদ্কে ঘৃণার চক্ষে দেখিয়াছেন, এখন সে হোসেন কোথা? আর হাসানই-বা কোথা? আজি পর্যন্তও কি আপনার অন্তরের গরিমা চক্ষের ঘৃণা অপরিসীম ভাবেই রহিয়াছে? আজ কার হাতে পড়িলেন, ভাবিয়াছেন কি? দেখুন দেখি চেষ্টায় কি না হয়? ধন, রাজ্য, রূপ তুচ্ছ করিয়াছিলেন; একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি, রাজ্যে কি না হইল? বিবি জয়নাব! মনে আছে? সেই আপনার গৃহ নিকটস্থ রাজপথ? মনে করুন যেদিন আমি সৈন্য-সামন্ত লইয়া মৃগয়ায় যাইতেছিলাম, আপনি আমাকে দেখিয়াই গবাক্ষ-দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। কে না জানিল যে, দামেস্কের রাজকুমার মৃগয়ায় গমন করিতেছেন। শত সহস্র চক্ষু আমাকে দেখিতে ঔৎসুক্যের সহিত ব্যস্ত হইল, কেবল আপনার দু’টি চক্ষু তখনই ঘৃণা প্রকাশ করিয়া আড়ালে অন্তর্ধান হইল। সেদিনের সে অহঙ্কার কই? সে দোলায়মান কর্ণাভরণ কোথা? সে কেশ শোভা মুক্তার জালি কোথা? এ বিষম সমর কাহার জন্য? এ শোণিতের প্রবাহ কাহার জন্য? কী দোষে এজিদ্ আপনার ঘৃণার্হ? কী কারণে এজিদ্ আপনার চক্ষের বিষ? কী কারণে দামেস্কের পাটরাণী হইতে আপনার অনিচ্ছা?”
জয়নাব আর সহ্য করিতে পারিলেন না। আরক্তিম লোচনে বলিতে লাগিলেন, “কাফের! তোর মুখের শাস্তি ঈশ্বর করিবেন। সর্বস্ব হরণ করিয়া একেবারে নিঃসহায়া-নিরাশ্রয়া করিয়া বন্দিভাবে দামেস্কে আনিয়াছিস্, তাই বলিয়াই কী এত গৌরব? তোর মুখের শাস্তি, তোর চক্ষের বিধান, যিনি করিবার তিনিই করিবেন। তোর হাতে পড়িয়াছি, যাহা ইচ্ছা বলিতে পারিস্! কিন্তু কাফের! ইহার প্রতিশোধ অবশ্য আছে। তুই সাবধানে কথা কহিস, জয়নাব নামে মাত্র জীবিতা,-এই দেখ, (বস্ত্রমধ্যস্থ খঞ্জর দর্শাইয়া) এমন প্রিয়বস্তু সহায় থাকিতে বল তো কাফের! তোকে কিসের ভয়?”
এজিদ্ আর কথা কহিলেন না। জয়নাবের নিকট কত কথা কহিবেন, ক্রমে মনের কপাট খুলিয়া দেখাইবেন, শেষে সজলনয়নে দুঃখের কান্না কাঁদিবেন,-তাহা আর সাহস হইল না। কৌশলে হোসেন-পরিবারদিগের হস্ত হইতে অস্ত্রাদি অপহরণ করিবার মানসে সে সময়ে আর বেশি বাক্যব্যয় করিলেন না। কেবল জয়নাল আবেদীনকে বলিলেন, “কি সৈয়দজাদা! তুমি কী করিবে?”
জয়নাল আবেদীন সক্রোধে বলিলেন, “তোমার প্রাণবধ করিয়া দামেস্ক নগরের রাজা হইব।”
এজিদ্ হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তোমার আছে কী? তুমি মাত্র একা, অথচ বন্দি, তোমার জীবন আমার হস্তে। মনে করিলে মুহূর্তমধ্যে তোমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া শৃগাল-কুকুরের উদরে দিতে পারি, এ অবস্থাতেও আমাকে মারিয়া দামেস্কের রাজা হইবার সাধ আছে?”
“আমার মনে যাহা উদয় হইল বলিলাম, এখন তোমার যাহা ইচ্ছা হয় কর। ইহা পার-উহা পার বলিয়া আমার নিকট গরিমা দেখাইয়া ফল কি?”
“ফল যাহা তো দেখিয়াই আসিতেছ। এখানেও কিছু দেখ। একটি ভাল জিনিস তোমাদিগকে দেখাইতেছি, দেখ।”
হোসেন-মস্তক পূর্বেই এক সুবর্ণ পাত্রে রাখিয়া এজিদ্ তদুপরি মূল্যবান্ বস্ত্রের আবরণ দিয়া রাখিয়াছিলেন; হোসেনের অল্পবয়স্কা কন্যা ফাতেমাকে এজিদ্ নিকটে বসাইলেন এবং বলিলেন, “বিবি! তোমার তো খর্জূর প্রিয়; এইক্ষণে যদি মদিনার খর্জূর পাও, তাহা হইলে কি কর?”
“কোথা খর্জূর? দিন, আমি খাইব!”
এজিদ্ বলিলেন, “ঐ পাত্রে খর্জূর রাখিয়াছি, আবরণ উন্মোচন করিলেই দেখিতে পাইবে! খুব ভাল খর্জূর উহাতে আছে! তুমি একা একা খাইয়ো না, সকলকেই কিছু কিছু দিয়ো।”
ফাতেমা বড় আশা করিয়া খর্জুর-লোভেপাত্রের উপরিস্থিত বস্ত্র উন্মোচন করিয়া বলিলেন, “এ কী? এ যে মানুষের কাটা মাথা! এ যে আমারই পিতার”-এই বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। পরিজনেরা হোসেনের ছিন্ন মস্তক দেখিয়া প্রথমে ঈশ্বরের নাম, পরে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বর! তোমার মহিমা অসীম, তুমি সকলই করিতে পার। দোহাই ঈশ্বর, বিলম্ব সহে না, দোহাই ভগবান্ আর সহ্য হয় না, একেবারে সপ্ততল আকাশ ভগ্ন করিয়া আমাদের উপর নিক্ষেপ কর। দয়াময়! আমাদের চক্ষের জ্যোতিঃ হরণ কর, বজ্রাস্ত্র আর কোন্ সময় ব্যবহার করিবে? দয়াময়। তোমাকে ধন্যবাদ দিয়াছি, এখনো দিতেছি। সকল সময়েই তোমার প্রতি নির্ভর করিয়াছি, এখনো করিতেছি; কিন্তু দয়াময়! এ দৃশ্য আর দেখিতে পারি না। আমাদের চক্ষু অন্ধ হউক, কর্ণ বধির হউক, এজিদের অমানুষিক কথা যেন আর শুনিতে না হয়। দয়াময়! আর কাঁদিব না। তোমাতেই আত্মসমর্পণ করিলাম।”
কী আশ্চর্য! সেই মহাশক্তিসম্পন্ন মহাকৌশলীর লীলা অবক্তব্য। পাত্রস্থ শির ক্রমে শূন্যে উঠিতে লাগিল। এজিদ্ স্বচক্ষে দেখিতেছেন, অথচ কিছুই বলিতে পারিতেছেন না। কে যেন তাঁহার বাক্শক্তি হরণ করিয়া লইয়াছে। পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, হোসেনের মস্তক হইতে পবিত্র জ্যোতিঃ বহির্গত হইয়া যেন আকাশের সহিত সংলগ্ন হইয়াছে। খণ্ডিত শির ক্রমে সেই জ্যোতির আকর্ষণে ঊর্ধ্বে উঠিতে লাগিল এবং দেখিতে দেখিতে অন্তর্হিত হইল।
এজিদ্ সভয়ে গৃহের ঊর্ধ্বভাগে বারবার দৃষ্টি করিতে লাগিলেন; দেখিলেন কোথাও কিছু নাই। পাত্রের প্রতি দৃষ্টি করিলেন; শূন্য পাত্র পড়িয়া আছে! যে মস্তক লইয়া কত খেলা করিবেন, হোসেন-পরিবারের সম্মুখে কত প্রকারে বিদ্রূপ করিয়া হাসি-তামাশা করিবেন, তাহা আর হইল না। কে লইল, কেন ঊর্ধ্বে উঠিয়া একেবারে অন্তর্ধান হইল, এত জ্যোতিঃ, এত তেজ, তেজের এত আকর্ষণশক্তি কোথা হইতে আসিল-এজিদ্ ভাবিতে ভাবিতে হতবুদ্ধিপ্রায় হইলেন! কোনই কারণ খুঁজিয়া পাইলেন না। কেবল একটি অপূর্ব সৌরভে কতক্ষণ পর্যন্ত রাজভবন আমোদিত করিয়াছিলেন, তাহাই বুঝিতে পারিলেন।
এজিদ্ মনে মনে যে সকল সঙ্কল্প রচনা করিয়াছিলেন, দুরাশা-সূত্র আকাশকুসুমে যে মালা গাঁথিয়া রাখিয়াছিলেন, দেখিতে দেখিতে তাহার কিছুই থাকিল না। অতি অল্প সময়মধ্যে আশাতে আশা, কুসুমে কুসুম মিলিয়া-মিশিয়া এক হইয়া গেল। ঐশ্বরিক ঘটনায় ধার্মিকের আনন্দ, চিত্তের বিনোদন,-পাপীর ভয়, মনে অস্থিরতা। এজিদ্ ভয়ে কাঁপিতে লাগিল; কি করিবে, কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না। অস্ফুট স্বরে এইমাত্র বলিল, “বন্দিগণকে কারাগারে লইয়া যাও।
উদ্ধার পর্ব ০৪ প্রবাহ
কথা চাপিয়া রাখা বড়ই কঠিন। কবিকল্পনার সীমা পর্যন্ত যাইতে হঠাৎ কোন কারণে বাধা পড়িলে মনে ভয়ানক ক্ষোভের কারণ হয়। সমাজের এমনই কঠিন বন্ধন, এমনই দৃঢ় শাসন যে কল্পনাকুসুমে আজ মনোমত হার গাঁথিয়া পাঠক-পাঠিকাগণের পবিত্র গলায় দোলাইতে পারিলাম না। শাস্ত্রের খাতিরে নানা দিক লক্ষ্য রাখিতে হইতেছে! হে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ভগবান্! সমাজের মূর্খতা দূর কর। কুসংস্কার তিমির সদ্জ্ঞান-জ্যোতিঃ প্রতিভায় বিনাশ কর। আর সহ্য হয় না। যে পথে যাই, সেই পথেই বাধা। সে পথের সীমা পর্যন্ত যাইতে মনের গতি রোধ তাহাতে জাতীয় কবিগণেরও বিভীষিকাময় বর্ণনায় বাধা জন্মায়, চক্ষে ধাঁধা লাগাইয়া দেয়; কিন্তু তাঁহারাও যে কবি, তাঁহাদের যে কল্পনাশক্তির বিশেষ শক্তি ছিল, তাহা সমাজ মনে করেন না। এই সামান্য আভাসেই যথেষ্ট, আর বেশি দূর যাইব না। বিষাদ-সিন্ধুর প্রথম ভাগেই স্বজাতীয় মূর্খদল হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন। অপরাধ আর কিছুই নহে, পয়গম্বর এবং ইমামদিগের নামের পূর্বে, বাঙলা ভাষায় ব্যবহার্য শব্দে সম্বোধন করা হইযাছে; মহাপাপের কার্যই করিয়াছি! আজ আমার অদৃষ্টে কী আছে, ঈশ্বরই জানেন। কারণ মর্ত্যলোকে থাকিয়া স্বর্গের সংবাদ প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণকে দিতে হইতেছে।
স্বর্গীয় প্রধান দূত জিবরাইল অতি ব্যস্ততাসহকারে ঘোষণা করিতেছেন,-’দ্বার খুলিয়া দাও। প্রহরিগণ! আজ স্বর্গের দ্বার, সপ্ততল আকাশের দ্বার খুলিয়া দাও। পুণ্যাত্মা, তপস্বী, সিদ্ধপুরুষ, ঈশ্বরভক্ত, ঈশ্বরপ্রণয়ী প্রাণিগণের অমরাত্মার বন্দিগৃহের দ্বার খুলিয়া দাও। স্বর্গীয় দূতগণ! অমরপুরবাসী নরনারীগণ! প্রস্তুত হও। হোসেনের এবং অন্য অন্য মহারথিগণের দৈনিক সৎক্রিয়া সম্পাদন জন্য মর্ত্যলোকে যাইবার আদেশ হইয়াছে। দ্বার খুলিয়া দাও, প্রস্তুত হও।”
মহাহুলস্থূল পড়িয়া গেল। “অল্পক্ষণের জন্য আবার মর্ত্যলোকে?” অমরাত্মা এই বলিয়া স্ব স্ব রূপ ধারণ করিলেন। এদিকে হজরত জিবরাইল আপন দলবল সহ সকলের পূর্বেই কার্বালা প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ক্রমে সকলের আবির্ভাব হইতে আরম্ভ হইল। দেখিতে দেখিতে জনমানবশূন্য প্রান্তরে, পুণ্যাত্মাদিগের আগমনে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। বালুকাময় প্রান্তরে সুস্নিগ্ধ বায়ু বহিয়া স্বর্গীয় সৌরভে চতুর্দিক মোহিত ও আমোদিত করিয়া তুলিল।
স্বর্গীয় দূতগণ স্বর্গসংস্রবী দেবগণ, সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হজরত আদম,-যিনি আমি পুরুষ যাঁহাকে অবজ্ঞা করিয়া প্রধান ফেরেশতা আজাজীল শয়তানে পরিণত হইয়াছিল, সেই স্বর্গীয় দূতগণ পূজিত হজরত আদম,-হোসেন-শোকে কাতর-ও স্নেহপরবশে প্রথমেই তাঁহার সমাগম হইল। পরে মহাপুরুষ মুসা-স্বয়ং ঈশ্বর তূর পর্বতে যাঁহার সহিত কথা কহিয়াছিলেন, মুসা সেই সচ্চিদানন্দের তেজোময় কান্তি দেখিবার জন্য নিতান্ত উৎসুক হইলে, কিঞ্চিৎ আভা মাত্র যাহা মুসার নয়নগোচর হইয়াছিল, তাহাতেই মুসা স্বীয় শিষ্যসহ সে তেজ ধারণে অক্ষম হইয়া অমনই অজ্ঞান অবস্থায় ধরাশায়ী হইয়াছিলেন, শিষ্যগণ পঞ্চত্ব পাইয়াছিল, আবার করুণাময় জগদীশ্বর, মুসার প্রার্থনায় শিষ্যগণকে পুনর্জীবিত করিয়া মুসার অন্তরে অটল ভক্তির নব-ভাব আবির্ভাব করিয়াছিলেন-সে মহামতি সত্য তার্কিক মুসাও আজি হোসেন-শোকে কাতর,-কারবালায় সমাসীন। প্রভু সোলেমান-যাঁর হিতোপদেশ আজ পর্যন্ত সর্বধর্মাবলম্বীর নিকট সমভাবে আদৃত,-সেই নরকিন্নরী দানবদলী ভূপতি মহামতিও আজ কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত। যে দাউদের গীতে জগৎ মোহিত, পশু পক্ষী উন্মত্ত, স্রোতস্বতীর স্রোত স্থির-ভাবাপন্ন, সে দাউদও আজ কারবালায়।
ঈশ্বর-প্রণয়ী ইব্রাহিম,-যাঁহাকে ঈশ্বরদ্রোহী রাজা নমরূদ প্রচণ্ড অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিয়া সত্য প্রেমিকের প্রাণসংহার করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, যে অগ্নিশিখা গগনম্পর্শী হইয়া জগজ্জনের চক্ষে ধাঁধা দিয়াছিল,-দয়াময়ের কৃপায় সে প্রজ্বলিত গগনস্পর্শী অগ্নি ইব্রাহিম চক্ষে বিকশিত কমলদলে সজ্জিত উপবন, অগ্নিশিখা সুগন্ধযুক্ত স্নিগ্ধকর গোলাপমালা বলিয়া বোধ হইয়াছিল,-সে সত্যবিশ্বাসী মহাঋষি আজ কারবালা ক্ষেত্রে সমাগত। ইসমাইল-যিনি নিজ প্রাণ ঈশ্বরোদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিয়া ‘দোম্বার’ পরিবর্তে নিজে বলি হইয়াছেন-সে ঈশ্বরভক্ত ইসমাইলও আজ কারবালা প্রান্তরে। ঈশা-যিনি প্রকৃত সন্ন্যাসী জগৎপরিত্রাতা মহাঋষি তাপস, ঈশ্বরের মহিমা দেখাইতে যে মহাত্মা চিরকুমারী মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন,-তিনিও আজ মর্ত্যধাম কারবালার মহাক্ষেত্রে। ইউনুস-যিনি মৎস্যগর্ভে থাকিয়া ভগবানের অপরিসীম ক্ষমতা দেখাইয়াছিলেন-তিনিও কারবালায়। মহামতি হজরত ইউসুফ বৈমায়েত্র ভ্রাতাকর্তৃক অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইয়া ঈশ্বরের কৃপায় জীবিত ছিলেন এবং দাস পরিচয়ে বিক্রীত হইয়া মিসর রাজ্যে রাজসিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন, সে মহা সুশ্রীর অগ্রগণ্য পূর্ণজ্যোতির আকর হজরত ইউসুফও আজ কারবালার মহাপ্রান্তরে। হজরত জার্জিসকে বিধর্মিগণ শতবার শতপ্রকারে বধ করিয়াছে, তিনিও পুনঃ পুনঃ জীবন প্রাপ্ত হইয়া দয়াময়ের মহিমার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখাইয়াছেন। সে ভুক্তভোগী হজরত জার্জিসও আজ কারবালাক্ষেত্রে।-এই প্রকার হজরত ইয়াকুব, আসহাব, ইসহাক, ইদ্রীস, আয়ুব, ইলিয়াস, হরকেল, শামাউন, লূত, এহিয়া, জাকারিয়া প্রভৃতি মহা মহা মহাত্মাগণের আত্মা অদৃশ্য শরীরে কারবালায় হোসেনের দৈহিক শেষ ক্রিয়ার জন্য উপস্থিত হইলেন।
সকলেই যেন কাহার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। ক্ষণকাল পরে সকলেই একেবারে দণ্ডায়মান হইয়া ঊর্ধ্বনেত্রে বিমান দিকে বারবার লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। আর সকলেই আরব্য ভাষায় “ইয়া নবী সালাম আলায়কা, ইয়া হাবিব সালাম আলায়কা, ইয়া রসুল সালাম আলায়কা, সালওয়াতোল্লাহ আলায়কা” সমস্বরে গাহিয়া উঠিলেন। সহস্র সহস্র লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মুখে মহাঋষি প্রভু হজরত মোহাম্মদের গুণানুবাদ হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে মৃদুমন্দভাবে শূন্য হইতে “হায় হোসেন! হায় হোসেন!” রব করিতে করিতে হজরত মোহাম্মদ উপস্থিত হইলেন! তাঁহার পবিত্র পদ ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করিল। এতদিন প্রকৃতি শরীরী জীবের মুখে “হায় হোসেন, হায় হোসেন!” রব শুনিয়াছিল; আজ দেবগণ, স্বর্গের হুর-গ্লামানগণ, মহাঋষি, যোগী, তপস্বী, অমরাত্মার মুখে শুনিতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!”
এই গোলযোগ না যাইতে-যাইতেই সকলে যেন মহাদুঃখে নির্বাকভাবে দণ্ডায়মান হইলেন। হায় হায়! পুত্রের কী স্নেহ! রক্ত, মাংস, ধমনী, অস্থি, শরীরবিহীন আত্মাও অপত্য-স্নেহে ফাটিয়া যাইতেছে, যেন মেঘ-গর্জনের সহিত শব্দ হইতেছে-হোসেন! হায় হোসেন! মরতজা আলী “শেরে খোদা” (ঈশ্বরের শার্দূল) স্বীয় পত্নী বিবি ফাতেমাসহ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দৈহিকের জন্য শোক অমূলক খেদ বৃথা। দৈহিক জীবের সহিত তাঁহাদের কোন সংস্রব নাই,-তথাপি পুত্রের এমনই মায়া যে, সে সকল মূলতত্ত্ব জ্ঞাত থাকিয়াও মহাত্মা আলী মহা খেদ করিতে লাগিলেন। জগতীয় বায়ু প্রকৃত আত্মায় বহমান হইয়া ভ্রমময় মহাশোকের উদ্রেক করিয়া দিল। কুহকিনী দুনিয়ার কুহকজালের ছায়া দেখিয়া হজরত আলী অনেক ভ্রমাত্মক কথা বলিতে লাগিলেন। “আন অশ্ব, আন তরবারি, এজিদের মস্তক এখনই সহস্র খণ্ডে খণ্ডিত করিব।” হায়! অপত্য স্নেহের নিকট তত্ত্বজ্ঞান, আত্মজ্ঞান, সকলই পরাস্ত।
সকল আত্মাই হজরত আলীকে প্রবোধ দিলেন। হজরত জিবরাইল আসিয়া বলিলেন, “ঈশ্বরের আদেশ প্রতিপালিত হউক। শহীদগণের দৈহিক সৎকারে প্রবৃত্ত হওয়া যাউক। অগ্রে শহীদগণের মৃতদেহ অন্বেষণ করিয়া সংগ্রহ করিতে হইবে; বিধর্মী, ধর্মী, স্বর্গীয়, নারকী, একত্র মিশ্রিত সমরাঙ্গণে অঙ্গে অঙ্গ মিশাইয়া রহিয়াছে; সেইগুলি বাছিয়া লইতে হইবে।” সকলেই শহীদগণের দেহ অন্বেষণে ছুটিলেন!
ঐ যে শিরশূন্য মহারথ-দেহ ধুলায় পড়িয়া আছে, খরতর তীরাঘাতে অঙ্গে সহস্র সহস্র ছিদ্র দৃষ্ট হইতেছে, পৃষ্ঠে একটি মাত্র আঘাত নাই,-সমুদয় আঘাতই বক্ষ পাতিয়া সহ্য করিয়াছে, এ কোন্ বীর? কবচ, কটিবন্ধ, বর্ম, চর্ম, অসি, বীর সাজের সমুদয় সাজ, সাজওয়া অঙ্গেই শোভা পাইতেছে, বয়সে কেবল নবীন যুবা। কী চমৎকার গঠন! হায়! হায়! তুমি কী আবদুল ওহাব? হে বীরবর! তোমার মস্তক কি হইল? তুমি কি সেই আবদুল ওহাব? যিনি চিরপ্রণয়িনী প্রিয়তমা ভার্যার মুখখানি একবার দেখিতে বৃদ্ধা মায়ের নিকট অনুনয়-বিনয় করিয়াছিলেন, মাতৃ আজ্ঞা প্রতিপালনে, অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই যিনি বীররমণী বীরবালার বঙ্কিম আঁখির ভাব দেখিয়া ও রণোত্তেজক কথা শুনিয়া অসংখ্য বিধর্মীর প্রাণ বিনাশ করিয়াছিলেন,-তুমি কি সেই আবদুল ওহাব?
বীরবরের পদপ্রান্তে এ আবার কে? এ বিশাল অক্ষি দুটি ঊর্ধ্বে উঠিয়াও বীরশ্রেষ্ঠ আবদুল ওহাবের সজ্জিত শরীর-শোভা দেখিতেছে। এক বিন্দু জল!!-ওহে এক বিন্দু জলের জন্য আবদুল ওহাব-পত্নী হত-পতির পদপ্রান্তে শুষ্ককণ্ঠা হইয়া আত্মবিসর্জন করিয়াছেন!
এ রমণীহৃদয়ে কে আঘাত করিল? এ কোমল শরীরে কোন পাষাণহস্ত অস্ত্রাঘাত করিয়া বৃদ্ধ বয়সে জীবলীলা শেষ করিল? রে কাফেরগণ! হোসেনের সহিত শত্রুতা করিয়া রমণী-বধেও পাপ মনে কর নাই? বীরধর্ম, বীর-নীতি, বীর-শাস্ত্রে কি বলে? যে হস্ত রমণী দেহে আঘাত করিতে উত্তোলিত হয়, সে হস্ত বীর অঙ্গের শোভনীয় নহে, সে বাহু বীর-বাহু বলিয়া গণনীয় নহে। নরাকার পিশাচের বাহু!সে বীর-কেশরী, সে বীরকুল-গৌরব, সে মদিনার ভাবি রাজা কোথায়? মহা মহা রথী যাঁহার অশ্ব-চালনায়, তীরের লক্ষ্যে, তরবারির তেজে, বর্শার ভাজে মুগ্ধ সে বীরবর কই? সে অমিত-তেজা রণকৌশলী কই? সে নব-পরিণয়ের নূতন পাত্র কই? এই তো শাহানা বেশ। এই তো বিবাহ সময়ের জাতিগত পরিচ্ছদ। এই কী সেই সখিনার প্রণয়ানুরাগ নব পুষ্পহার পরিণয়সূত্রে গলায় পরিয়াছিল! এই কী সেই কাসেম! হায়! হায়!! রুধিরের কী অন্ত নাই!
সখিনা সমুদয় অঙ্গে, পরিধেয় বসনে রুধির মাখিয়া বীর-জায়ার পরিচয়-বিবাহের পরিচয় দিয়াছেন, তবু রুধিরের ধারা বহিতেছে-মণিময় বসনভূষণ, তরবারি, অঙ্গে শোভা পাইতেছে। তূণীর, তীর, বর্শা দেহপার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বাম পার্শ্বে এ মহাদেবী কে? এ নবকমলদলগঠনা নবযুবতী সতী কে? চক্ষু দু’টি কাসেমের মুখ দেখিতে দেখিতে যেন বন্ধ হইয়াছে, জানিত কি অজানিতভাবে বাম হস্তখানি কাসেমের বক্ষের উপর রহিয়াছে। সত্যি! তুমি কে? তোমার দক্ষিণ হস্তে এ কী? এ কী ব্যাপার-কমলকরে লৌহ অস্ত্র! সে অস্ত্রের অগ্রভাগ কই? উহু! কি মর্মঘাতী দৃশ্য! বদ্ধমুষ্টিতে অস্ত্র ধরিয়া হৃদয়-কন্দরে প্রবেশ করাইয়াছ! তুমি কী সখিনা? তাহা না হইলে এত দুঃখ কার? স্বামীর বিরহ-বেদনায় কাতর হইয়া আত্মবিসর্জন করিয়াছ? না-না-বীর-জায়া, বীর-দুহিতা কী কখনো স্বামী-বিরহে কী বিয়োগে আত্মবিসর্জন করে? কী ভ্রম! কী ভ্রম! তাহা হইলে এ বদনে হাসির আভা কেন থাকিবে? জ্যোতির্ময় কমলাননে জ্বলন্ত প্রদীপ প্রভা কেন রহিবে? বুঝিলাম-বিরহ কি বিয়োগ দুঃখে এ তীক্ষ্ণ খঞ্জরে হৃদয়-শোণিত, স্বামী দেহ বিনির্গত শোণিতে মিশ্রিত হয় নাই। স্বামী বিয়োগে অধীরা হইয়া দুঃখভার হ্রাস করিতেও খ রের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় নাই। ধন্য সতী! ধন্য সতী সখিনা! তুমি জগতে ধন্য, তোমার সুকীর্তি জগতে অদ্বিতীয় কীর্তি! কী মধুময় কথা বলিয়া খঞ্জরহস্তে কহিয়াছিলে? জগৎ দেখুক। জগতের নরনারীকুল তোমায় দেখুক। এত প্রণয়, এত ভালবাসা, এত মমতা, এত স্নেহ, এক শোণিতে গঠিত যে কাসেম সেই আমার পরিণয়ে আবদ্ধ, নব প্রেমে দীক্ষিত-যে ঘটনায় নিতান্ত অপরিচিত হইলেও মুহূর্তমধ্যে প্রণয়ের ও প্রেমের সঞ্চার হয়,-সতীত্ব ধন রক্ষা করিতে সেই কাসেমকে মুক্তকণ্ঠে বলিলে, “ভুলিলাম কাসেম, এখন তোমায় ভুলিলাম।” এই চিরস্মরণীয় মহামূল্য কথা বলিয়া যাহা করিলে, তাহাতে অপরের কথা দূরে থাকুক,-নির্দয়হৃদয় মারওয়ানের অন্তরেও দয়ার সঞ্চার হইয়াছিল। ধন্য, ধন্য সখিনা! সহস্র ধন্যবাদ তোমারে!
এ প্রান্তরে এ রূপরাশি কাহার? এ অমূল্য রত্ন ধরাসনে কেন? ঈশ্বর তুমি কি না করিতে পার? একাধারে এত রূপ প্রদান করিয়া কি শেষে ভ্রম হইয়াছিল? সেই আজানুলম্বিত বাহু, সেই বিস্তারিত বক্ষ, সেই আকর্ণ বিস্তারিত অক্ষিদ্বয়, কি চমৎকার ভ্রূযুগল, ঈষৎ গোঁফের রেখা! হায়! হায়! ভগবান্ এত রূপবান্ করিয়া কি শেষে তোমার ঈর্ষা হইয়াছিল? তাহাতেই কি এই কিশোর বয়সে আলী আকবর আজ চির-ধরাশায়ী।
এ যুগল মূর্তি এক স্থানে পড়িয়া কেন? এ ননীর পুতুল রক্তমাখা অঙ্গে মহাপ্রান্তরে পড়িয়া কেন? বুঝিলাম, ইহাও এজিদের কার্য। রে পাষণ্ড পিশাচ! হোসেনের ক্রীড়ার পুত্তলি দুটিও ভগ্ন করিয়াছিস্; হায়! হায়! এই তো সেই ফোরাতনদী, ইহার ভয়ানক প্রবাহ মৃত শরীর সকল স্রোতে ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। নদীগর্ভে স্থানে স্থানে লৌহিত, স্থানে স্থানে কিঞ্চিৎ লোহিত, কোন স্থানে ঘোর পীত, কোন স্থানে নীলবর্ণের আভাসংযুক্ত স্রোত বহিয়া নিদারুণ শোক প্রকাশ করিতেছে। -হোসেন-শোকে ফোরাতের প্রতি তরঙ্গ মস্তক নত করিয়া রঞ্জিত জলে মিশিয়া যাইতেছে।
শব্দ হইল, “এ আমার কোমরবন্ধ, এ যে আমার শিরস্ত্রাণ, এ যে আমারই তরবারি, এ সকল এখানে পড়িয়া কেন?” আবার শব্দ হইল, “এ সকলই তো হোসেনের আয়ত্তাধীনে ছিল!”
এই তো সেই মহাপুরুষ-মদিনার রাজা! এ প্রান্তরে বৃক্ষতলে পড়িয়া কেন? রক্তমাখা খ র কাহার? এ তো হোসেনের অস্ত্র নহে। অঙ্গের বসন, শিরাস্তরণ, কবচ, স্থানে স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে, কারণ কি? তাহাতেই কী এই দশা? এ কি আত্ম-বিকারের চিহ্ন, না ইচ্ছামৃত্যুর লক্ষণ? বাম হস্তের অর্ধ পরিমাণ খণ্ডিত হইয়াও দুই হস্ত দুই দিকে পড়িয়া যে উপদেশ দিতেছে, তাহার অর্থ কি জগতে কেহ বুঝিয়াছে? বাম হস্তে আবার কে আঘাত করিল? মস্তক খণ্ডিত হইয়াও জন্মভূমি মদিনার দিকে ফিরিয়া রহিয়াছে! হায় রে জন্মভূমি!!
সীমার মস্তক লইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে গিয়াছিল, আজরও সেই মস্তক এই দেহে সংযুক্ত করিবার আশয়ে পুত্রগণের মস্তক কাটিয়া দিয়াও কৃতকার্য হইতে পারে নাই। এজিদ্, কত খেলা খেলিবে, কত অপমান করিবে, আশা করিয়া মস্তক দামেস্কে লইয়া গিয়াছিল। ধন্য হে কারিগরি! ধন্য রে ক্ষমতা! জগদীশ! তোমার মহিমা অপার। তুমি যাহা সংঘটন করিয়া একত্র করিতে ইচ্ছা কর, তাহা অত্যুচ্চ পর্বতশিখরে থাক্, ঘোর অরণ্যে থাক্, অতল জলধিতলে থাক্ অনন্ত আকাশে থাক্ বায়ু অভ্যন্তরে থাক্ তাহা সংগ্রহ করিয়া একত্র করিবেই করিবে। এ লীলা বোঝা মানবের সাধ্য নহে, এ কীর্তির কণামাত্র বুঝাও ক্ষুদ্র নর মস্তকের কার্য নহে। জগদীশ! প্রাণ খুলিয়া বলিতেছি, “তুমি সর্বশক্তিমান্ অদ্বিতীয় প্রভু! তোমার মহিমা অপার!!”
স্বর্গীয় দূতগণ, পবিত্র আত্মাগণ, শহীদগণের দৈহিক ক্রিয়ার যোগ দিলেন, স্বর্গীয় সুগন্ধে সমাধিস্থান আমোদিত হইতে লাগিল।
শহীদগণের শেষক্রিয়া “জানাজা” করিতে অন্য অন্য মৃত শরীরের ন্যায় জলে স্নান করাইতে হয় না, অন্য বসন দ্বারা শরীর আবৃত করিতে হয় না, ঐ রক্তমাখা শরীর সজ্জিত বেশে, ঐ বীর-সাজে মন্ত্র পাঠ করিয়া মৃত্তিকায় প্রোথিত করিতে হয়। ধর্মযুদ্ধের কী অসীম বল, কী অসীম পরিণাম ফল!
দৈহিক কার্য শেষ হইলে শহিদগণ দিব্যজ্ঞান লাভ করিয়া ঈশ্বরের আদেশে স্বর্গে নীত হইলেন।
উদ্ধার পর্ব ০৫ প্রবাহ
স্বাধীন – কি মধুমাখা কথা! স্বাধীন জীবন কি আনন্দময়! স্বাধীন দেশ আরামের স্থান! স্বাধীন ভাবের কথাগুলি কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলে হৃদয়ের সূক্ষ্ম শিরা পর্যন্ত আনন্দোচ্ছ্বাসে স্ফীত হইয়া উঠে এবং অন্তরে বিবিধ ভাবের উদয় হয়। হয় মহাহর্ষে মন নাচিতে থাকে, না হয় মহাদুঃখে অন্তর ফাটিয়া যায়। স্বাধীন মন, স্বাধীন জীবন, পরাধীন স্বীকার করিতে যেরূপ কষ্ট বোধ করে, আবার অন্যকে অধীনতা স্বীকার করাইতে পারিলে ঐ অন্তরেই অসীম আনন্দ অনুভব হয়। এক পক্ষের দুঃখ, অপর পক্ষের সুখ।
এজিদ্ স্বরাজ্যে স্বাধীন। সকলেই তাহার আদেশের অধীন! জয়নালকে হাসি-রহস্যচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “তুই কি করিবি?” জয়নালের মুখে তাহার উত্তরও শুনিয়াছে। ক্রমে বশে আনিয়া, ক্রমে শান্তভাব ধরাইয়া, কার্যসিদ্ধির উপায় না করিলে এইক্ষণে কিছুই হইবে না। জয়নালকে প্রাণে মারিয়া, মদিনার সিংহাসনে বসিলে কোন লাভ নাই। জয়নাল নিয়মিতরূপে মদিনার কর দামেস্কে যোগাইলে দামেস্ক সিংহাসনের সহস্র প্রকারে গৌরব। কিন্তু সিংহ-শাবককে বশে আনা সহজ কথা নহে। কিছুদিন চেষ্টা করিয়া দেখা কর্তব্য। প্রথমেই নিরাশ হইয়া হোসেন-বংশ একেবারে বিনাশ করিলে বাহাদুরি কি? এই সকল আশার কুহকে পড়িয়া এজিদ্ বন্দিগণ প্রতি সুব্যবস্থার অনুমতি করিয়াছিল।
জয়নাল কিসে বশ্যতা স্বীকার করে, কিসে প্রভু বলিয়া মান্য করে, কি উপায় করিলে নির্বিঘ্নে মদিনা রাজ্য করতলস্থ হয়, অধীন দাসত্বকলঙ্করেখা জয়নালের সুপ্রশস্ত ললাটে অক্ষয়রূপে অঙ্কিত হয়, এজিদ্ এই সকল মহাচিন্তার ভার নিজ মস্তকে লইয়াও কৃতকার্য হইতে পারে নাই। বিনা যুদ্ধে মদিনার সম্রাট্ হওয়া সহজ কথা নহে! এজিদের মস্তক কেন-লোকমান আফ্লাতুন প্রভৃতি মহা মহা চিন্তাশীল মহজ্জনের মস্তিষ্কও এ চিন্তায় ঘুরিয়া যায়। কিন্তু এজিদের এমনই দৃঢ়বিশ্বাস যে, মারওয়ান চেষ্টা করিলে অবশ্যই ইহার কোন এক প্রকারের সদুপায় বাহির করিবে। মনের ব্যগ্রতায় দামেস্কের বহুলোকের প্রতি তাহার চক্ষু পড়িল, কিন্তু মারওয়ান ভিন্ন ইহার স্থির সিদ্ধান্ত করার উপযুক্ত পাত্র মানবচক্ষে কাহাকেও দেখিতে পাইল না।
মারওয়ান উপস্থিত হইলে, এজিদ্ ঐ সকল গুপ্ত বিষয়ের স্থির সিদ্ধান্ত করিতে কহিলেই মারওয়ান একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “আগামী জুম্মাবারে (শুক্রবারে) জয়নাল দ্বারা মহারাজ নামে খোৎবা পাঠ করাইব। এক্ষণে সমগ্র প্রদেশে হোসেনের নামে খোৎবা হইতেছে। কারণ হোসেনের পর এ পর্যন্ত মদিনায় রাজা কেহ হয় নাই। জয়নাল যদি আপন পিতার নাম পরিত্যাগ করিয়া মহারাজের নামে খোৎবা পাঠ করে, তবেই কার্যসিদ্ধি-তবেই দামেস্কের জয়-তবেই বিনা যুদ্ধে মদিনা করতলে। যাঁহার নামে খোৎবা, তিনিই মক্কা-মদিনার রাজা। এখনই রাজ্যমধ্যে ঘোষণা করিয়া দিতেছি যে, আগামী জুম্মাবারে, শেষ ইমাম জয়নাল আবেদীন,-দামেস্ক-সম্রাট্ মহারাজাধিরাজ এজিদ্ নামদার নামে খোৎবা পাঠ করিবেন। নগরের যাবতীয় ঈশ্বরভক্ত লোককেই উপাসনা-মন্দিরে খোৎবা শুনিতে উপস্থিত হইতে হইবে। যিনি রাজ আজ্ঞা অবহেলা করিবেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহার শিরচ্ছেদ করা যাইবে।”
এজিদ্ মহা তুষ্ট হইয়া মারওয়ানকে যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করিল। মুহূর্তমধ্যে রাজঘোষণা দামেস্ক নগরের ঘরে ঘরে প্রকাশ হইল। ঘোষণার মর্মে অনেকেই সুখী হইল, আবার অনেকে মাথায় হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। তাহাদের হৃদয়ে বিষম আঘাত লাগিল। প্রকাশ্যে কোন কথা বলিবার সাধ্য নাই-রাজদ্রোহী সাব্যস্ত হইয়া প্রাণ যায়। গোপনে গোপনে বলিতে লাগিল, “এতদিন পরে নূরনবী মোহাম্মদের প্রচারিত ধর্মে কলঙ্করেখা পতিত হইল! হায় হায়! কি মর্মভেদী ঘোষণা! হায় হায়! ইসলাম ধর্মের এত অবমাননা! কাফেরের নামে খোৎবা। বিধর্মী নারকী ঈশ্বরদ্রোহীর নামে খোৎবা। হা ইসলাম ধর্ম! দুরন্ত জালেমের হস্তে পড়িয়া তোমার এই দুর্দশা! হায় হায়! পুণ্যভূমি মদিনার সিংহাসন যাঁহার আসন, সেই শেষ ইমাম জয়নাল আবেদীন, কাফেরের নামে খোৎবা পড়িবে? সে খোৎবা শুনিবে কে? সে উপাসনাগৃহে যাইবে কে? আমরা অধীন প্রজা, না যাইয়া নিস্তার নাই। জগদীশ! আমাদের কর্ণ বধির কর, চক্ষুর জ্যোতি হরণ কর, চলচ্ছক্তি রহিত কর।”
মোহাম্মদীয়গণ নানা প্রকারে অনুতাপ করিতে লাগিলেন। এজিদ্ পক্ষীয় বিধর্মীরা দর্প করিয়া বলিতে লাগিল, “মোহাম্মদ বংশের বংশমর্যাদার চিরগৌরব এখন কোথায় রহিল? ধন্য মন্ত্রী মারওয়ান!”
এ সকল সংবাদ বন্দিরা এখন পর্যন্ত জানিতে পারে নাই! এজিদ্ মনে করিয়াছে, উহাদের জীবন আমার হস্তে,-মুহূর্তে প্রাণ রাখিতে পারি, মুহূর্তে বিনাশ করিতে পারি। জুম্মার দিন জয়নালকে ধরিয়া আনিয়া মস্জিদে পাঠাইয়া দিব। যদি আমার নামে খোৎবা পড়িতে অস্বীকার করে, রাজাজ্ঞা অমান্য করার অপরাধে তখনই উহার প্রাণবিনাশ করিব।
জুম্মাবার উপস্থিত; নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই মোহাম্মদীয়গণ প্রাণের ভয়ে উপাসনা-মন্দিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জয়নাল আবেদীনের নিকটে যাইয়া মারওয়ান বলিল, “আজ তোমাকে মস্জিদে খোৎবা পড়িতে হইবে।”
জয়নাল বলিলেন, “আমি প্রস্তুত আছি। ইমামদিগের কার্যই উপাসনায় অগ্রবর্তী হওয়া, খোৎবা পাঠ, ধর্মের আলোচনা, শিষ্যদিগকে উপদেশ দান;-সুতরাং ঐ সকল আমার কর্তব্য কার্য। তুমি অপেক্ষা কর, আমি আমার মায়ের অনুমতি লইয়া আসিতেছি।”
“তোমার মা’র অনুমতি লইতেই যদি চলিলে, তবে আর একটি কথা শুনিয়া যাও।”
“কি কথা?”
“খোৎবা পড়িতে হইবে বটে, কিন্তু তোমার নামে পড়িতে পারিবে না।”
জয়নাল চক্ষু পাকল করিয়া বলিলেন, “কেন পারিব না?”
“কেন-র কোন উত্তর নাই,-রাজার আজ্ঞা।”
“ধর্মচর্চায় বিধর্মী রাজার আজ্ঞা কি? আমার ধর্মকর্ম আমি করিব, তাহাতে তোমাদের কথা কি? আমি যতদিন মদিনার সিংহাসনে না বসিব ততদিন পিতার নামেই খোৎবা পাঠ করিব: এই তো রাজার আজ্ঞা। তুমি কোন্ রাজার কথা বল?”
“তুমি নিতান্তই অবোধ, কিছুই বুঝিতেছ না। তোমার মার নিকট বলিলে তিনি সকলই বুঝিতে পারিবেন।”
“আমি অবোধ না হইলে তোমাদের বন্দিখানায় কেন আসিব? আর কী কথা আছে বল। আমি মা’র নিকটে যাইতেছি।”
“যিনি দামেস্কের রাজা, তিনিই এক্ষণে মদিনার রাজা। মক্কা ও মদিনা একই রাজার রাজ্য হইয়াছে। এখন ভাব দেখি, কাহার নামে খোৎবা পড়া কর্তব্য?”
“আমি ও-প্রকারের কথা বুঝিতে পারি না। যাহা বলিবার হয়, স্পষ্টভাবে বল।”
“তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান নাই; কেবল থাকিবার মধ্যে আছে-রাগ আর নিজের অহঙ্কার। বাদশা এজিদের নামে খোৎবা পড়িতে হইবে।”
জয়নাল আবেদীন রোষে এবং দুঃখে সজলনয়নে বলিতে লাগিলেন, “কাফেরের নামে আমি খোৎবা পড়িব? এজিদ্ কোন্ দেশের রাজা? আর সে কোন্ রাজার পুত্র?”
মারওয়ান অতিব্যস্তে জয়নাল আবেদীনকে ধরিয়া সস্নেহে বলিতে লাগিল, “সাবধান! সাবধান!! ও-কথা মুখে আনিয়ো না। ও-কথা মুখে আনিলে নিশ্চয় তোমার মাথা কাটা যাইবে।”
“আমি মাথা কাটাইতে ভয় করি না। তুমি আমার নিকট হইতে চলিয়া যাও; আমি খোৎবা পড়িতে যাইব না।”
মারওয়ান মনে করিয়াছিল যে, জয়নালকে বলিবামাত্র সে খোৎবা পড়িতে আসিবে। কিন্তু তাহার কথা শুনিয়া অবাক্ হইল। এদিকেও উপাসনার সময় অতি নিকট। মারওয়ান মনে মনে বলিতে লাগিল, “এ সিংহশাবকের নিকট চাতুরী চলিবে না, বল প্রকাশ করিলেও কার্য উদ্ধার হইবে না। সালেমা বিবির নিকট যাইয়া বলি;-তিনি সর্বশ্রেষ্ঠা, বয়সেও প্রবীণা, অবশ্যই ভাল-মন্দ বিবেচনা করিয়া জয়নালকে সম্মত করাইয়া দিবেন। সকলেই এক বন্দিগৃহে।”
মারওয়ান সালেমা বিবির নিকট যাইয়া বলিল, “আপনাদের কপালের এমনই গুণ যে ভাল করিতে গেলেও মন্দ হইয়া যায়। আমার ইচ্ছা যে কোন প্রকারে এই বিপদ হইতে আপনারা উদ্ধার পান।”
সালেমা বিবি বলিলেন, “কি প্রকারে ভাল করিতে ইচ্ছা কর?”
“মহারাজ এজিদ্ নামদার আজ্ঞা করিয়াছেন যে, জয়নাল আবেদীনের দ্বারা আজিকার জুম্মার খোৎবা পড়াইয়া তাঁহাদিগকে কারামুক্ত করিয়া দাও।”
“ভাল কথা। জয়নাল কই? তাহাকে এ-কথা বলিয়াছ?”
“বলিয়াছি এবং তাহার উত্তর শুনিয়াছি!”
“সে কী উত্তর করিল? তার বুদ্ধি কী?”
“বুদ্ধি খুব আছে, ক্রোধও খুব আছে।”
“ক্রোধের কথা বলিয়ো না। বাপু! তাহারা ধর্মের দাস, ধর্মই তাহাদের জীবন; বোধ হয়, ধর্মসংক্রান্ত কোন কথা বলিয়া থাকিবে। ধর্মবিরোধী কথা তাহাদের কর্ণে প্রবেশ না করিলে কখনোই সে শরীরে ক্রোধের সঞ্চার হয় না।”
“মহারাজ আজ্ঞা করিয়াছেন, আজ হোসেনের নাম পরিবর্তন করিয়া মক্কা ও মদিনা এইক্ষণে যাঁহার করতলে, জয়নাল আবেদীন তাঁহারই নামে খোৎবা পাঠ করুন। আমি আজই তাঁহাদিগকে বন্দিগৃহ হইতে মুক্ত করিয়া মদিনায় পাঠাইয়া দিব। জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিয়া রাজত্ব করুন,-কিন্তু তাঁহাকে দামেস্করাজের অধীনে থাকিতে হইবে!”
“এ কী কথা! বন্দি হইয়া আসিয়াছি বলিয়াই কী সে ধর্মের প্রতি হস্তক্ষেপ করিবে? আমাদের প্রতি যে অত্যাচার করিতেছে তাহাকে যথার্থ ধার্মিক বলিয়া কিরূপে স্বীকার করিব? হজরত মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ্র প্রচারিত ধর্মে যে দীক্ষিত নহে, মদিনার সিংহাসনের যে অধীশ্বর নহে, তাহার নামে কী প্রকারে খোৎবা পাঠ হইতে পারে? তাও আবার পাঠ করিবে-জয়নাল আবেদীন! এ কী কথা!”
“আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, একটু শান্ত হউন! বন্দিভাবে থাকিয়া এতদূর বলা নিতান্ত অন্যায়। যাহা হউক, আমি বলি, যদি খোৎবাটা পড়িলেই মুক্তিলাভ হয়, তাহাতে হানি কী? জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারিলে কি আর তাঁহার উপর দামেস্করাজের কোন ক্ষমতা থাকিবে? তখন যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারিবেন, ইহাতে আর আপনাদের ক্ষতি কি?”
“ক্ষতি কিছুই নাই;-কিন্তু-”
“আর ‘কিন্তু’ কথা মুখে আনিবেন না, প্রাণ বাঁচাইবার জন্য অনেক-”
“জয়নালকে একবার ডাকিতে বল।”
জয়নাল আবেদীন আড়ালে থাকিয়া সকলই শুনিতেছিলেন, সালেমা বিবির কথার আভাসেই নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। মহারোষের চিহ্ন এবং ক্রোধের লক্ষণ দেখিয়া, সালেমা বিবি অনুমানেই অনেক বুঝিলেন। সস্নেহে জয়নালের কপোলদেশ চুম্বন করিয়া অতি নম্রভাবে বলিতে লাগিলেন, “এজিদের নামে খোৎবা পড়ায় দোষ কি? যদি ভগবান্ কখনো তোমার সুখসূর্যের মুখ দেখান, তোমার নামে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক খোৎবা পাঠ করিবে। এখন মারওয়ানের কথা শুনিলে বোধ হয় ঈশ্বর ভালই করিবেন।”
জয়নাল বলিলেন, “আপনিও কী এজিদের নামে খোৎবা পড়িতে অনুমতি করেন?”
“আমি অনুমতি করি না; তবে ইহা বলিতে পারি যে, তোমার মুক্তির জন্য আমরা সকলে প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি। একদিন খোৎবা পড়িলেই যদি তুমি সপরিবারে বন্দিগৃহ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পার, মদিনার সিংহাসনে নির্বিবাদে বসিতে পার, তবে তাহাতে ক্ষতি কি ভাই? আরো কথা,-তুমি ইচ্ছা করিয়া এই কুকার্যে রত হইতেছ না। এ পাপ তোমাতে অর্পিবে না।”
সামান্য কারামুক্তি আর মদিনার রাজ্যলাভ জন্য আমি এজিদের নামে খোৎবা পড়িব? এ বন্দিগৃহ হইতে মুক্তির জন্য ভয় কী? শক্তি থাকিলেই মুক্তি হইবে। যদি কেহ রাজ্য কাড়িয়া লইয়া থাকে তাহার নিকট ভিক্ষা করিয়া রাজ্যগ্রহণ করা অপেক্ষা অস্ত্রে তাহার মস্তক নিপাত করাই আমার কথা।”
সালেমা বিবি জয়নালের মুখে শত শত চুম্বনপূর্বক আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ হউক! ঈশ্বর তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন।”
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “আপনারা এরূপ গোলযোগ করিলে কোন কার্যই সিদ্ধ হইবে না। আর সময় নাই; যদি মদিনা যাইবার ইচ্ছা থাকে, এজিদের হস্ত হইতে পরিত্রাণের আশা থাকে, জয়নালকে খোৎবা পাঠ করিতে প্রেরণ করুন; ইহাতে সম্মত না হন, আমার অপরাধ নাই, আমি নাচার।”
সালেমা বিবি বলিলেন, “জয়নাল! তুমি ঈশ্বরের নাম করিয়া মস্জিদে যাও। তোমার ভাল হইবে।”
জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “আপনি যাইতে আজ্ঞা করিলেন?”
“হাঁ, আমি যাইতে আজ্ঞা করিলাম। তোমার কোন চিন্তা নাই। আরো একটি কথা বলিতেছি, শুন! শুনিয়া মনে মনে বিচার করিলেই ভাল-মন্দ বুঝিতে পারিবে। একদা তোমার পিতামহ হজরত আলী কাফেরদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে আম্বাজ নামে এক নগরে গমন করিয়াছিলেন। সেখানে যাইয়া শুনিলেন, এদেশ পুরুষাধিকারে নহে, একজন রাজ্ঞীর অধিকারভুক্ত। আরো আশ্চর্য কথা,-রাজ্ঞী এ পর্যন্ত বিবাহ করেন নাই; তাঁহার পণ এই, বাহুযুদ্ধে যে তাঁহাকে পরাস্ত করিবে, তাঁহাকেই পতিত্বে বরণ করিবেন, আর রাজ্ঞী জয়ী হইলে পরাজিত পক্ষকে আজীবন দাসত্ব স্বীকার করিয়া তাঁহার দাসভাবে থাকিতে হইবে। মহাবীর আলী স্ত্রীলোকের এই পণের কথা শুনিয়া যুদ্ধে প্রস্তুত হইলেন। বিবি হনুফাও কম ছিলেন না। আরবীয় যাবতীয় বীরকে তিনি জানিতেন। তাঁহারও মনে মনে ইচ্ছা ছিল যে, আলীকে পরাস্ত করিয়া একজন মহাবীর দাস লাভ করিবেন। ঘটনাক্রমে সুযোগ ও সময় উপস্থিত-দিন নির্ণয় হইল। রূপের গরিমায়-যৌবনের জ্বলন্ত প্রতিভায় বিবি হনুফা আরবের সুবিখ্যাত বীরকেও তুচ্ছজ্ঞানে সমরাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু ঈশ্বরের মহিমায় যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া মোহাম্মদীয় ধর্ম গ্রহণপূর্বক মহাবীর আলীকে স্বামীত্বে বরণ করিলেন। হজরত আলী বিবি ফাতেমার ভয়ে এ কথা মদিনার কাহারো নিকট প্রকাশ করেন নাই। সময়ে বিবি হনুফার গর্ভে এক পুত্রসন্তান হয়। আলী সে সময়ে মহা চিন্তিত হইয়া কি করেন-কথাও গোপন থাকে না। বিবি ফাতেমার ভয়ও কম নহে। পুত্রকে গোপনে আনাইয়া একদা প্রভু মোহাম্মদের পদপ্রান্তে ফেলিয়া দিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান হইলেন। প্রভু মোহাম্মদ পুত্রটিকে ক্রোড়ে লইয়া মুখে চুমা দিয়া বলিলেন, “আমি সকলই জানি। আমি ইহার নাম, ইহার মাতার নামের সহিত এবং আমার নামের সহিত যোগ করিয়া রাখিলাম।” বিবি ফাতেমা দেখিলেন যে, একটি অপরিচিত সন্তানকে প্রভু ক্রোড়ে করিয়া বারবার মুখে চুমা দিতেছেন। বিবি ফাতেমা সন্তানের কথা জিজ্ঞাসা করায় প্রভু সমুদয় বৃত্তান্ত প্রকাশ করিলে, বিবি ফাতেমা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া পিতাকে এক প্রকার ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “আমার সপত্নীপুত্রকে আপনি স্নেহ করিতেছেন? আর কোন্ বিবেচনায় আপনার নামের সহিত যোগ করিয়া নাম রাখিলেন?”
প্রভু বলিলেন, “ফাতেমা, শান্ত হও! এই মোহাম্মদ হানিফা তোমার কি কি উপকার করিবে, শুন। যে সময়ে প্রিয় পুত্র হোসেন কারবালার মহাপ্রান্তরে এজিদের আজ্ঞায় সীমার হস্তে শহীদ হইবে, তৎকালে তোমার বংশে এক জয়নাল আবেদীন ভিন্ন পুরুষপক্ষে আর কেহ থাকিবে না; তোমার আত্মীয়-স্বজন ভগিনী পুত্রবধূরা এজিদের সৈন্যহস্তে কারবালা হইতে দামেস্কে বন্দিভাবে আসিবে। তাহাদের কষ্টের সীমা থাকিবে না। সেই কঠিন সময়ে এই মোহাম্মদ হানিফা যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে উদ্ধার করিবে, জয়নাল আবেদীনকে মদিনার সিংহাসনে বসাইবে।” বিবি ফাতেমা পিতৃমুখে এই সকল কথা শুনিয়া, মোহাম্মদ হানিফাকে আহ্লাদে ক্রোড়ে করিয়া হানিফার আপাদমস্তকে চুমা দিয়া আশীর্বাদপূর্বক বলিলেন, “প্রাণাধিক! তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার হৃদয়ের ধন, মস্তকের মণি। আমার চুম্বিত স্থানে কোনরূপ অস্ত্র প্রবেশ করিবে না! তুমি সর্বদা সর্বজয়ী হইয়া জগতে মহাকীর্তি স্থাপন করিবে। আশীর্বাদ করি, তুমি দীর্ঘজীবী হও!” যে সময়ে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধের সূচনা হয়, সেই সময় আমি গোপনে একজন কাসেদকে মোহাম্মদ হানিফার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত বলিয়া পাঠাইয়াছি। মোহাম্মদ হানিফা শীঘ্রই দামেস্কে আসিয়া আমাদিগকে উদ্ধার করিবেন। এই তো শাস্ত্রের কথা। এখন সকলই ঈশ্বরের হাত। আরো একটি কথা,-হোসেন যুদ্ধকালে কি বলিয়া গিয়াছেন মনে হয়? তিনি বলিয়াছেন, “তোমরা ভাবিয়ো না, এমন একটি লোক আছে, যদি তাহার কর্ণে এই সকল ঘটনার অণুমাত্রও প্রবেশ করে, ইহার প্রতিশোধ সে অবশ্যই লইবে। সে কে? এই মোহাম্মদ হানিফা।”
জয়নাল আবেদীন এই পর্যন্ত শুনিয়া আর বিলম্ব করিলেন না। খোৎবা পাঠ করিবেন স্বীকার করিয়া উপাসনার সমুচিত পরিধেয় লইয়া বহির্গত হইলেন, মারওয়ান সঙ্গে সঙ্গে যাইতে লাগিল! নগরে হুলস্থূল পড়িয়াছে-আজ জয়নাল আবেদীন এজিদের নামে খোৎবা পাঠ করিবে। মারওয়ানের আনন্দের সীমা নাই। আজ এজিদের আশা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হইবে। জয়নাল উপাসনা-মন্দিরে প্রবেশ করিয়া উপাসনান্তর খোৎবা পাঠ আরম্ভ করিলেন। মোহাম্মদীয়গণের অন্তরে খোৎবার শব্দগুলি সুতীক্ষ্ণ ছুরিকার ন্যায় বিদ্ধ হইতে লাগিল। কোন্ মুখে জয়নাল আবেদীন মদিনার ইমামের নাম অর্থাৎ হোসেনের নামের স্থানে এজিদের নাম উচ্চারণ করিবেন? হায়! হায়! এ কী হইল? কিন্তু সময় উপস্থিত হইলে মদিনার সিংহাসনের যথার্থ উত্তরাধিকারী যিনি তাঁহারই নামে খোৎবা পাঠ হইল। খতিবের (খতিব-যে খোৎবা পাঠ করে।) মুখে কেহ এজিদের নাম শুনিল না। পূর্বেও যে নাম এখনো সেই হোসেনের নাম স্পষ্ট শুনিল।
মোহাম্মদীয়গণ মনের আবেগে আনন্দ-উল্লাসে জয় জয় করিয়া উঠিল। এজিদ্পক্ষ রোষে ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হইয়া জয়নাল আবেদীনকে নানা প্রকার কটুবাক্যে ভর্ৎসনা করিতে করিতে ভজনালয় হইতে বহির্গত হইল।
নিষ্কোষিত অসিহস্তে এজিদ্ ক্রোধে অধীর। কম্পিত কলেবরে কর্কশ স্বরে অসি ঝন্ঝনির সহিত রসনা সঞ্চালন করিয়া বলিল, “এখনই জয়নালের শিরচ্ছেদ করিব! এত চাতুরী আমার সঙ্গে?”
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “বাদশা নামদার! আশা-সিন্ধু এখনো পার হই নাই। বহুদূরে আসিয়াছি বলিয়া ভরসা হইয়াছে,-অচিরেই তীরে উঠিব। কিন্তু মহারাজ! আজ যে একটা গোপনীয় কথা শুনিয়াছি তাহাতে জয়নাল আবেদীনের জীবন শেষ করিলে ইমামবংশ সমূলে বিনাশ হইবে না, বরং সমরানল সতেজে জ্বলিয়া উঠিবে। সে দুর্দান্ত প্রমত্ত রাবণকে মারওয়ান যতদিন কৌশলাঙ্কুশে হোসেনের দাদ উদ্ধার পর্যবেক্ষণ হইতে নিবারণ করিতে না পারিবে, ততদিন মারওয়ানের মনে শান্তি নাই, আপনার জীবনে আশা নাই।”
এজিদ্ মৃত্তিকায় তরবারি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “সে কী কথা? হোসেনবংশে এখনো প্রমত্ত কুঞ্জরসম বীরশ্রেষ্ঠ বীর আছে? আমি তো আর কাহাকেও দেখিতে পাই না?”
মারওয়ান বলিল, “জয়নালকে নির্দিষ্ট বন্দিগৃহে প্রেরণ করিবার আদেশ হউক। আমি সে গুপ্ত কথা-নিগূঢ়তত্ত্ব এখনই বলিতেছি।”
উদ্ধার পর্ব ০৬ প্রবাহ
যে নগরে সুখসাগরে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ খেলা করিতেছিল, মহানন্দের স্রোত বহিতেছিল; রাজপ্রাসাদ, রাজপথ, প্রধান প্রধান সৌধ আলোকমালায় পরিশোভিত হইয়াছিল; ঘরে ঘরে নৃত্য, গীত, বাজনার ধুম পড়িয়াছিল, রঙ্গিন পতাকা সকল হেলিয়া-দুলিয়া জয়সূচক চিহ্ন দেখাইতেছিল;-হঠাৎ সমুদয় বন্ধ হইয়া গেল! মুহূর্তমধ্যে মহানন্দবায়ু থামিয়া বিষাদ-ঝটিকা-বেগ রহিয়া রহিয়া বহিতে লাগিল। মাঙ্গলিক পতাকারাজি নতশিরে হেলিতে-দুলিতে পড়িয়া গেল। রাজপ্রাসাদের বাদ্যধ্বনি, নূপুরের ঝন্ঝনি, সুমধুর কণ্ঠস্বর, আর কাহারো কর্ণে প্রবেশ করিল না। সুহাস্য আস্য সকল বিষাদ-কালিমা রেখায় মলিন হইয়া গেল। কেহ কাহারো সঙ্গে কথা কহিতেছে না, জিজ্ঞাসা করিলেও উত্তর পাইতেছে না। রাজভবনের অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন দেখিয়া কতজনে কত কথার আলোচনায় বসিয়া গেল। শেষে সাব্যস্ত হইল, গুরুতর মনঃপীড়া হঠাৎ পরিবর্তন, নিশ্চয়ই হঠাৎ শ্রবণ। দুঃখের কথা বটে! কারবালার সংবাদ-বিবি সালেমার প্রেরিত কাসেদের আগমন।
এ প্রদেশের নাম আম্বাজ। রাজধানী হনুফানগরে! এই সমৃদ্ধিশালী মহানগরীর দণ্ডধর মোহাম্মদ হানিফা। সম্রাট্ স্বীয় কন্যার বিবাহ উপলক্ষে আমোদ-আহ্লাদে মাতিয়াছিলেন, শুভ সময়ে শুভ কার্য সুসম্পন্ন করিবেন আশা ছিল, এমন সময়ে কাসেদ আসিয়া হরিষে সম্পূর্ণ বিষাদ ঘটাইয়া মোহাম্মদ হানিফাকে নিতান্তই দুঃখিত করিয়াছে!
হাসানের সাংঘাতিক মৃত্যু, জেয়াদের সখ্যতা, মারওয়ানের আচরণ, কুফার পথ ভুলিয়া হোসেনের কারবালায় গমন ও ফোরাত নদীর তীরে শত্রুপক্ষ হইতে বেষ্টন, এই সকল কথা শুনিয়া ক্রোধে, বিষাদে নরপাল মহা অস্থির। কাসেদ সম্মুখে অবনতশিরে দণ্ডায়মান।
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “হা! জীবিত থাকিতেই ভ্রাতা হাসানের মৃত্যুসংবাদ শুনিতে হইল। ভ্রাতা হোসেনও কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে কষ্টে পড়িয়া আছেন! হায়! এতদিন না জানি কী ঘটনাই ঘটিয়া থাকিবে! জগদীশ! আমার এই প্রার্থনা, দাসের এই প্রার্থনা, কারবালা প্রান্তরে যাইয়া যেন ভ্রাতার পবিত্র চরণ দেখিতে পাই, পিতৃহীন কাসেমের মুখখানি যেন দেখিতে পাই। দয়াময়! আমার পরিজনকে রক্ষা করিয়ো, দুরন্ত কারবালাপ্রান্তরে তুমি ভিন্ন তাহাদের সহায় আর কেহ নাই। দয়াময়! দয়াময়!! আমার মনে শান্তি দান কর। আমি স্থির মনে অটলভাবে যেন কারবালায় গমন করিতে পারি। পূজ্যপাদ ভ্রাতার সাহায্য করিয়া কৃতার্থ হইতে পারি। দয়াময়! আমার শেষ ভিক্ষা এই যে, তোমার এ চিরকিঙ্করের চক্ষু কারবালার প্রান্তসীমা না দেখা পর্যন্ত হোসেন-শিবির শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়ো।”
এই প্রকার উপাসনা করিয়া মোহাম্মদ হানিফা সৈন্যগণকে প্রস্তুত হইতে আদেশ করিলেন। আরো বলিলেন, “আমার সঙ্গে কারবালায় যাইতে হইবে। আমি এ নগরে আর ক্ষণকালের জন্যও থাকিব না। রাজকার্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তে ন্যস্ত থাকিল।”
মোহাম্মদ হানিফা ঈশ্বরের নাম করিয়া বীর-সাজে সজ্জিত হইলেন। যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ গাজী রহমানকে প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ পদে বরণ করিয়া কারবালাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কাসেদ সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
উদ্ধার পর্ব ০৭ প্রবাহ
তোমার এ দুর্দশা কেন? কোন কুক্রিয়ার ফলে তোমার এ দশা ঘটিয়াছে? যখন পাপ করিয়াছিলে, তখন কি তোমার মনে কোন কথা উদয় হয় নাই? এখন লোকালয়ে মুখ দেখাইতে এত লজ্জা কেন? খোল, খোল, মুখের আবরণ খোল; দেখি কি হইয়াছে। চিরপাপী পাপপথে দণ্ডায়মান হইলে হিতাহিত জ্ঞান অণুমাত্রও তাহার অন্তরে উদয় হয় না। যেন-তেন প্রকারেণ পাপকূপে ডুবিতে পারিলেই এক প্রকারে রক্ষা পায়,-কিন্তু পরক্ষণে অবশ্যই আত্মগ্লানি উপস্থিত হয়।
পাঠক! লেখনীর গতি বড় চমৎকার। ষষ্ঠ প্রবাহে কোথায় লইয়া গিয়াছি, আবার সপ্তম প্রবাহে কোথায় আনিয়াছি। সম্মুখে পবিত্র রওজা, পুণ্যভূমি মদিনার সেই রওজা। পবিত্র রওজার মধ্যে অন্য লোকের গমন নিষেধ, এ-কথা আপনারা পূর্ব হইতেই অবগত আছেন। আর যাহার জন্য উপরে কয়েকটি কথা বলা হইল সে আগন্তুক কী করিতেছে, দেখিতেছেন? সে পাপী পাপমোচন জন্য এখন কি কি করিতেছে, দেখিতেছেন? রওজার বহির্ভাগস্থ মৃত্তিকার ধূলি অনবরত মুখে-মস্তকে মর্দন করিতেছে, আর বলিতেছে, “প্রভু রক্ষা কর। হে হাবিবে খোদা, আমায় রক্ষা কর। হে নূরনবী হজরত মোহাম্মদ, আমায় রক্ষা কর। তুমি ঈশ্বরের প্রিয় বন্ধু। তোমার নামের গুণে নরকাগ্নি নরদেহ নিকটে আসিতে পারে না। তোমার রওজার পবিত্র ধূলিতে শত শত জরাগ্রস্ত মহাব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নীরোগ হইয়া সুকান্তি লাভ করিতেছে, তাহাদের সাংঘাতিক বিষের বিষাক্ত গুণ হ্রাস হইতেছে। সেই বিশ্বাসে এই নরাধম পাপী বহু কষ্টে পবিত্র ভূমি মদিনায় আসিয়াছে। যদিও আমি প্রভু হোসেনের সহিত অমানুষিক ব্যবহার করিয়াছি-দয়াময়! হে দয়াময় জগদীশ! তোমার করুণা-বারি পাত্রভেদে নিপতিত হয় না। দয়াময়! তোমার নিকট সকলই সমান। জগদীশ! এই পবিত্র রওজার ধূলির মাহাত্ম্যে আমায় রক্ষা কর।”
ক্রমে এক-দুই করিয়া জনতা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। আগন্তুকের আত্মগ্লানি ও মুক্তিকামনার প্রার্থনা শুনিয়া সকলেই সমুৎসুক হইয়া, কোথায় নিবাস, কোথা হইতে আগমন, এই সকল প্রশ্ন করিতে লাগিল। আগন্তুক বলিল, “আমার দুর্দশার কথা বলি। ভাই রে! আমি ইমাম হোসেনের দাস। প্রভু যখন সপরিবারে কুফায় গমনের জন্য মদিনা হইতে যাত্রা করেন, আমি তাঁহার সঙ্গে ছিলাম। দৈব নির্বান্ধে কুফার পথ ভুলিয়া আমরা কারবালায় যাই।”
সকলে মহাব্যস্তে-”তারপর? তারপর?”
“তারপর কারবালায় যাইয়া দেখি যে, এজিদ্ সৈন্য পূর্বেই আসিয়া ফোরাতনদীকূল ঘিরিয়া রাখিয়াছে। একবিন্দু জললাভের আর আশা নাই। আমার দেহমধ্যে কে যেন আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। সমুদয় বৃক্তান্ত, আমি একটু সুস্থ না হইলে বলিতে পারিব না। আমি জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিলাম।”
মদিনাবাসীরা আরো ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর কী হইল, বল; জল না পাইয়া কী হইল?”
“আর কী বলিব-রক্তারক্তি, মার মার, কাট কাট,-আরম্ভ হইল, প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবল তরবারি চলিল; কারবালার মাঠে রক্তের স্রোত বহিতে লাগিল, মদিনার কেহ বাঁচিল না!”
“ইমাম হোসেন, ইমাম হোসেন?”
“ইমাম হোসেন সীমার হস্তে শহীদ্ হইলেন।”
সমস্বরে আর্তনাদ ও সজোরে বক্ষে করাঘাত হইতে লাগিল। মুখে “হায় হোসেন! হায় হোসেন!!”
কেহ কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, “আমরা তখনই বারণ করিয়াছিলাম যে, হজরত মদিনা পরিত্যাগ করিবেন না। নূরনবী হজরত মোহাম্মদের পবিত্র রওজা পরিত্যাগ করিয়া কোন স্থানে যাইবেন না।”
কেহ কেহ আর কোন কথা না শুনিয়া ইমাম শোকে কাঁদিতে কাঁদিতে পথ বাহিয়া যাইতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ ঐ স্থানে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর, যুদ্ধ অবসানের পর কী হইল?”
“যুদ্ধ অবসানের পর কে কোথায় গেল, কে খুঁজিয়া দেখে। স্ত্রীলোকমধ্যে যাহারা বাঁচিয়া ছিল, ধরিয়া ধরিয়া উটে চড়াইয়া দামেস্কে লইয়া গেল। জয়নাল আবেদীন যুদ্ধে যায় নাই, মারাও পড়ে নাই। আমি জঙ্গলে পলাইয়া ছিলাম। যুদ্ধ শেষে ইমামের সন্ধান করিতে রণক্ষেত্রে শেষে ফোরাত নদীতীরে গিয়া দেখি যে, এক বৃক্ষ-মূল হোসেনের দেহ পড়িয়া আছে, কিন্তু মস্তক নাই, রক্তমাখা খঞ্জরখানিও ইমামের দেহের নিকট পড়িয়া আছে। আমি পূর্ব হইতে জানিতাম যে, ইমামের পায়জামার বন্ধমধ্যে বহুমূল্য একটি মুক্তা থাকিত। সেই মুক্তা লোভে দেহের নিকটে গিয়া যেমন খুলিতেছি, অমনই ইমামের বাম হস্ত আসিয়া সজোরে আমার দক্ষিণ হস্ত চাপিয়া ধরিল। আমি মহা ভীত হইলাম, সে হাত কিছুতেই ছাড়ে না। মুক্তাহরণ করা দূরে থাকুক, আমার প্রাণ লইয়া টানাটানি। সাত-পাঁচ ভাবিয়া নিকটস্থ খঞ্জর বাম হস্তে উঠাইয়া সেই পবিত্র হস্তে আঘাত করিতেই, হাত ছাড়িয়া গেল। কিন্তু কর্ণে শুনিলাম-”তুই অনুগত দাস হইয়া আপন প্রভুর সহিত এই ব্যবহার করিলি? সামান্য মুক্তালোভে ইমামের হস্তে আঘাত করিলি? তোর শাস্তি-তোর মুখ কৃষ্ণবর্ণ কুকুরের মুখে পরিণত হউক, জগতেই নরকাগ্নির তাপে তোর অন্তর, মর্ম, দেহ সর্বদা জ্বলিতে থাকুক।”
“এই আমার দুর্দশা, এই আমার মুখের আকৃতি দেখুন। আমি আর বাঁচিব না, সমুদয় অঙ্গে যেন আগুন জ্বলিতেছে। আমি পূর্ব হইতেই জানি যে, হজরতের রওজার ধূলি গায়ে মাখিলে মহারোগও আরোগ্য হয়, জ্বালা-যন্ত্রণা সকলই কমিয়া জল হইয়া যায়। সেই ভরসাতেই মহা কষ্টে কারবালা হইতে এই পবিত্র রওজায় আসিয়াছি।”
মদিনাবাসিগণ এ পর্যন্ত শুনিয়াই আর কেহ তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিলেন না। সকলেই ইমাম-শোকে কাতর হইলেন। নগরের প্রধান প্রধান এবং রাজসিংহাসন-সংস্রবী মহোদয়গণ, সেই সময়ে নগরমধ্যে ঘোষণা করিয়া কি কর্তব্য স্থির করিবার জন্য, রওজার নিকটস্থ উপাসনা -মন্দির সম্মুখে মহাসভা আহ্বান করিয়া একত্রিত হইলেন।
কেহ বলিলেন, “এজিদকে বাঁধিয়া আনি।”
কেহ বলিলেন, “দামেস্ক নগর ছারখার করিয়া দেই।”
বহু তর্ক-বিতর্কের পর শেষে সুস্থির হইল যে, “নায়ক বিহনে স্ব-স্ব প্রাধান্যে ইহার কোন প্রতিকারই হইবে না। আমরা মদিনার সিংহাসনে একজন উপযুক্ত লোককে বসাইয়া তাহার অধীনতা স্বীকার করি। প্রবল তরঙ্গমধ্যে শিক্ষিত কর্ণধার বিহনে যেমন তরী রক্ষা কঠিন, রাজবিপ্লব বিপদে একজন ক্ষমতাশালী অধিনায়ক না হইলে, রাজ্য রক্ষা করাও সেইরূপ মহা কঠিন। স্ব-স্ব প্রাধান্যে কোন কার্যেরই প্রতুল নাই।”
সমাগত দলমধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিলেন, “কাহার অধীনতা স্বীকার করিব? পথের লোক ধরিয়া কী মদিনার সিংহাসনে বসাইতে ইচ্ছা করেন? মদিনাবাসীরা কোন্ অপরিচিত নীচ বংশীয়ের নিকট নতশিরে দণ্ডায়মান হইবে। প্রভু মোহাম্মদের বংশে তো এমন কেহ নাই যে, তাঁহাকে সিংহাসনে বসাইয়া জন্মভূমির গৌরব রক্ষা করিব।”
প্রথম বক্তা বলিলেন, “কোন চিন্তা নাই, মোহাম্মদ হানিফা এখনো বর্তমান আছেন। হোসেনের পর তিনি আমাদের পূজ্য, তিনিই রাজা। ইহার পর হোসেনের আরো বৈমাত্রেয় ভ্রাতা অনেক আছেন। কারবালার এই লোমহর্ষক ঘটনা শুনিয়া, তাঁহারা কি স্ব-স্ব সিংহাসনে বসিয়াই থাকিবেন? ইহার পর নূরনবী মোহাম্মদের ভক্ত অনেক রাজা আছেন; এই সকল ঘটনা তাঁহাদের কর্ণগোচর হইলে তাঁহারাই কি নিশ্চিন্তভাবে থাকিবেন? এজিদ্ ভাবিয়াছে কী? মনে করিয়াছে যে, হোসেনবংশ নির্বংশ করিয়াছি-নিশ্চিন্তে থাকিবে; তাহা কখনোই ঘটিবে না, চতুর্দিক হইতে সমরানল জ্বলিয়া উঠিবে। আমরা এখনই উপযুক্ত একজন কাসেদ হনুফানগরে প্রেরণ করি। আপাততঃ মোহাম্মদ হানিফাকে সিংহাসনে বসাইয়া যদি জয়নাল আবেদীন প্রাণে বাঁচিয়া থাকেন, তবে তাঁহার উদ্ধারের উপায় করি। সঙ্গে সঙ্গে এজিদের দর্প চূর্ণ করিতেও সকলে আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।”
সকলে এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, তখন হনুফানগরে কাসেদ প্রেরিত হইল।
প্রথম বক্তা পুনরায় বলিলেন, “মোহাম্মদ হানিফা মদিনায় না-আসা পর্যন্ত আমরা কিছুই করিব না। শোকবস্ত্র যা যে অঙ্গে ধারণ করিয়াছি রহিল। জয়নাল আবেদীনের উদ্ধার, এজিদের সমুচিত শাস্তি বিধান না করিয়া আর এ শোক-সিন্ধুর প্রবল তরঙ্গের প্রতি কখনোই দৃষ্টি করিব না। আঘাত লাগুক, প্রতিঘাতে অন্তর ফাটিয়া যাউক, মুখে কিছুই বলিব না। কিন্তু সকলেই ঘরে ঘরে যুদ্ধ-সাজের আয়োজনে প্রস্তুত হও।”
এই প্রস্তাবে সকলে সম্মত হইয়া সভাভঙ্গ করিলেন। হোসেন-শোকে সকলেই অন্তরে কাতর; কিন্তু নিতান্ত উৎসাহে যুদ্ধ সজ্জার আয়োজনে ব্যাপৃত হইলেন। নগরবাসিগণের অঙ্গে, দ্বিতল ত্রিতল গৃহ-দ্বারে এবং গবাক্ষে শোকচিহ্ন। নগরের প্রান্তসীমায় শোকসূচক ঘোর নীলবর্ণ নিশান উড্ডীন হইয়া জগৎ কাঁদাইতে লাগিল।
এদিকে দামেস্কনগরে আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিল। এজিদের লক্ষাধিক সৈন্য সমর সাজে সজ্জিত হইয়া মদিনাভিমুখে যাত্রা করিল। হানিফার মদিনা আগমনের পূর্বেই সৈন্যগণ মদিনা-প্রবেশপথে অবস্থিতি করিয়া, হানিফার গমনে বাধা দিবে, ইহাই মারওয়ানের মন্ত্রণা। মোহাম্মদ হানিফা প্রথমে কারবালায় গমন করিবেন, তৎপরে মদিনায় না যাইয়া মদিনাবাসীদের অভিমত না লইয়া হজরতের রওজা পরিদর্শন না করিয়া, কখনোই দামেস্ক আক্রমণ করিবেন না-ইহাই মারওয়ানের অনুমান। সুতরাং মদিনা-প্রবেশপথে সৈন্য সমবেত করিয়া রাখাই আবশ্যক এবং সেই প্রবেশপথে হানিফার দর্প চূর্ণ করিয়া, জীবন শেষ করাই যুক্তি। সেই সিদ্ধান্তই নির্ভুল মনে করিয়া এজিদ্ মারওয়ানের অভিমতে মত দিল;-তাই আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিল। ওত্বে অলীদ দামেস্ক হইতে আবার মদিনাভিমুখে সৈন্যসহ চলিল। হানিফার প্রাণ বিনাশ, কি বন্দি করিয়া দামেস্কে প্রেরণ না-করা পর্যন্ত মদিনা আক্রমণ করিবে না। কারণ মোহাম্মদ হানিফাকে পরাস্ত না করিয়া মদিনার সিংহাসন লাভ করিলে কোন লাভ নাই। বরং নানা বিঘ্ন, নানা আশঙ্কা; এই যুক্তির উপর নির্ভর করিয়াই ওত্বে অলীদ মদিনাভিমুখে যাইতে লাগিল। ওত্বে অলীদ নির্বিঘ্নে যাইতে থাকুক, আমরা একবার হানিফার গম্য-পথ দেখিয়া আসি।
উদ্ধার পর্ব ০৮ প্রবাহ
কী চমৎকার দৃশ্য! মহাবীর মোহাম্মদ হানিফা অশ্ব-বল্গা সজোরে টানিয়া অশ্ব-গতিরোধ করিয়াছেন। গ্রীবা বক্র, দৃষ্টি পশ্চাৎ-কারণ সৈন্যগণ কতদূরে তাহাই লক্ষ্য। অশ্ব সম্মুখস্থ পদদ্বয় কিঞ্চিৎ বক্রভাবে উত্তোলন করিয়া দণ্ডায়মান। একপার্শ্বে মদিনার কাসেদ। হানিফার চক্ষু জলে পরিপূর্ণ। দেখিতে দেখিতে অর্ধচন্দ্র এবং পূর্ণতারা সংযুক্ত নিশান হেলিয়া-দুলিয়া ক্রমেই নিকটবর্তী হইল। গাজী রহমান উপস্থিত প্রভুর সজল চক্ষু, মুখভাব মলিন, নিকটে অপরিচিত কাসেদ-বিষাদের স্পষ্ট লক্ষণ, নিশ্চয়ই বিপদ! মহাবিপদ! বুঝি হোসেন ইহজগতে নাই।
“গাজী রহমান! আপনার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত! মোহাম্মদ হানিফা ভ্রাতৃহারা, জ্ঞাতিহারা হইয়া এইক্ষণে জ্ঞানহারা হইবার উপক্রম হইয়াছেন। রক্ষার উপায় দেখুন। ভ্রাতৃশোক মহাশোক!”
মোহাম্মদ হানিফা গদগদ-স্বরে বলিলেন, “গাজী রহমান, আর কারবালায় যাইতে হইল না, বিধির নির্বন্ধে, ভ্রাতৃবর হোসেন শত্রুহস্তে প্রাণ হারাইয়াছেন! ইমাম বংশ সমূলে বিনাশ হইয়াছে। পরিজনমধ্যে যাঁহারা বাঁচিয়া আছেন, তাঁহারাও দামেস্কনগরে এজিদ্ কারাগারে বন্দি। এইক্ষণ কী করি? আমার বিবেচনায় অগ্রে মদিনা যাইয়া প্রভু মোহাম্মদের রওজা পরিদর্শন করি? পরে অন্য বিবেচনা।”
আবদুর রহমান বলিলেন, “এ অবস্থায় মদিনাবাসীদিগের মত গ্রহণ করাও নিতান্ত আবশ্যক। রাজাবিহনে সেখানেও নানাপ্রকার বিভ্রাট উপস্থিত হইতে পারে। ইমাম বংশে কেহ নাই এ কথা যথার্থ হইল পুণ্যভূমি মদিনা যে এতদিন এজিদ্ পদভরে দলিত হয় নাই,-ইহারই-বা বিশ্বাস কি? তবে অনিশ্চিতে অন্য চিন্তা নিরর্থক! মদিনাভিমুখে যাওয়াই কর্তব্য।”
পুনরায় মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে, ভবিষ্যতের লেখা খণ্ডন করিতে কাহারো সাধ্য নাই। মদিনাভিমুখে গমনই যখন স্থির হইল, তখন বিশ্রামের কথা যেন কাহারো অন্তরে আর উদয় না হয়! সৈন্যগণ সহ আমার পশ্চাৎগামী হও।”
দিবারাত্রি গমন। বিশ্রামের নাম কাহারো মুখে নাই। এই প্রকার কয়েক দিন অবিশ্রান্ত গমন করিলে দ্বিতীয় কাসেদের সহিত দেখা হইল। জাতীয় নিশান দেখিয়াই মোহাম্মদ হানিফা গমনে ক্ষান্ত দিলেন।
কাসেদ যথাবিধি অভিবাদন করিয়া জোড়করে বলিল,-”বাদশাহ নামদার। দাসের অপরাধ মার্জনা হউক। আমি মদিনার কাসেদ।”মোহাম্মদ হানিফা বিশেষ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সংবাদ কি?”
“পূর্বসংবাদ বাদশাহ নামদারের অবিদিত নাই। তৎপর যে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, আর আমি যাহা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি,-বলিতেছি!”
“বাদশাহ নামদার! আপনার ভ্রাতৃবংশে পুরুষপক্ষে কেবলমাত্র এক জয়নাল আবেদীন জীবিত আছেন। তিনিও তাঁহার মাতা, ভগ্নী, পিতৃব্য পত্নী, দামেস্ক নগরে বন্দি। দিনান্তে এক টুকরা শুষ্ক রুটি, একপাত্র জল ভিন্ন আর কোন প্রকার খাদ্যের মুখ দেখিতে তাঁহাদের ভাগ্যে নাই। এজিদ্ এই সময় অগ্নিমূর্তি ধারণ করিয়া বসিয়াছে-সে কেবল আপনার সংবাদে আপনার প্রাণ বিনাশ করাই এক্ষণে তাহার প্রথম কার্য। ওত্বে অলীদকে লক্ষাধিক সৈন্যসহ সাজাইয়া মদিনার সীমায় পাঠাইয়া দিয়াছে। ওত্বে অলীদ মদিনা আক্রমণ না করিয়া আপনার প্রতীক্ষায় মদিনা-প্রবেশপথ রোধ করিয়া সর্বদা সতর্ক ও প্রস্তুতভাবে রহিয়াছে। অলীদ আপনার শিরচ্ছেদ করিয়া পরে মদিনার সিংহাসনে এজিদ্ পক্ষ হইতে বসিবে-ইহাই ঘোষণা করিয়াছে। এক্ষণে যাহা ভাল হয় করুন।”
মোহাম্মদ হানিফা এবার এক নূতন চিন্তায় নিপতিত হইলেন। সহজে মদিনা যাইবার আর সাধ্য নাই-প্রথমে যুদ্ধ-পরে প্রবেশ, তারপর মদিনাবাসিদিগের সহিত সাক্ষাৎ।
গাজী রহমান বলিলেন, “তবে যুদ্ধ অনিবার্য। যেখানে বাধা সেইখানেই সমর এত বিষম ব্যাপার। অলীদ চতুরতা করিয়া এমন কোন স্থানে যদি শিবির নির্মাণ করিয়া থাকে যে, সম্মুখে সুপ্রশস্ত সমতল ক্ষেত্র নাই, শিবির নির্মাণের উপযুক্ত স্থান নাই, জলের সুযোগ নাই, সৈন্যদিগের দৈনিক ক্রীড়া করিবার উপযুক্ত প্রাঙ্গণ নাই, তবে তো মহা বিপদ। অগ্রেই গুপ্তচর, চিত্রকর এবং কুঠারধারিগণকে ছদ্মবেশে প্রেরণ করিতে হইতেছে।”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “আমার মতি স্থির নাই যাহা ভাল বিবেচনা হয় করুন। তবে এইমাত্র কথা যে, বিপদে-সম্পদে, শোকে-দুঃখে সর্বদা সকল সময় যে ভগবান্-তাঁহারই নাম করিয়া চলিতে থাকুন। যাহা অদৃষ্টে আছে ঘটিবে। আর এখান হইতে আমার আর-আর বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃগণ যাঁহারা যেখানে আছেন তাঁহাদিগকে ইমামের অবস্থা ইমাম-পরিবারের অবস্থা বিস্তারিতরূপে লিখিয়া কাসেদ পাঠাও। এ কথাও লিখিয়া দাও যে, পদাতিক, অশ্বারোহী, ধানুকী প্রভৃতি যত প্রকার যোধ যাহার অধীনে যত আছে, তাহাদের আহার সংগ্রহ করিয়া মদিনা প্রান্তরে আসিয়া আমার সহিত যোগদান করুন। ইরাক নগরে মস্হাব কাক্কা, আঞ্জাম নগরে ইব্রাহিম ওয়াদি, তোগান রাজ্যে অলিওয়াদের নিকটে সমুদয় বিবরণ লিখিয়া কাসেদ প্রেরণ কর। আর-আর মুসলমান রাজা যিনি যে প্রদেশে, যে নগরে রাজ্য বিস্তার করিয়া আছেন, তাঁহাদের নিকটও এই সকল সমাচার লিখিয়া কাসেদ প্রেরণ কর। শেষে এই কয়েকটি কথা লিখিয়ো যে, ভ্রাতৃগণ! যদি জাতীয় ধর্ম রক্ষার বাসনা থাকে, জগতে মোহাম্মদীয় ধর্মের স্থায়িত্ব রাখিতে ইচ্ছা থাকে, কাফেরের রক্তে ইমাম-অস্ত্র রঞ্জিত করিবার ইচ্ছা থাকে, আর প্রভু মোহাম্মদের প্রতি যদি অটল ভক্তি থাকে, তবে এই পত্রপ্রাপ্তিমাত্র আপন-আপন সৈন্যসহ মদিনা-প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হও। প্রভু-পরিবারের প্রতি যে দৌরাত্ম্য হইতেছে, সে বিষয় আলোচনা করিয়া এখন কেহ দুঃখিত হইও না। এখন ধর্মরক্ষা, মদিনার সিংহাসন রক্ষা, এজিদের বধ, হোসেন-পরিজনের উদ্ধার, এই সকল কথাই যেন জপমালার মন্ত্র হয়।
এক্ষণে কেহ চক্ষের জল ফেলিয়ো না। কাঁদিবার দিনে সকলে একত্র হইয়া কাঁদিব। শুধু আমরা কয়েকজনেই যে কাঁদিব, তাহা নহে; জগৎ কাঁদিবে। এ জগৎ চিরদিন কাঁদিবে। স্বর্গীয় দূত ইসরাফিল জীবের জীবনলীলা শেষ করিতে যেদিন ঘোর রোলে শিঙ্গা বাজাইয়া জগৎ সংহার করিবেন, সেদিন পর্যন্ত জগৎ কাঁদিবে। দুঃখ করিবার দিন ধরা রহিল! এখন অস্ত্র ধরুন, শত্রু বিনাশ করুন, মোহাম্মদীয় দীন, ঐ শিঙ্গাবাদন দিন পর্যন্ত অক্ষয়রূপে স্থায়িত্বের উপায় বিধান কর। গাজী রহমান! এ সকল কথা লিখিতে কখনো ভুলিয়ো না।”
গাজী রহমান প্রভুর আদেশমত ‘শাহীনামা’ পত্র, যাহা যাহার নিকট উপযুক্ত, তখনই লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সৈন্যগণ ক্রমে আসিয়া জুটিল। মন্ত্রীপ্রবর-রাজাদেশে সকল শ্রেণীর প্রধান প্রধান অধ্যক্ষগণকে সমস্ত বিবরণ জ্ঞাপন করাইলেন। নির্দিষ্ট স্থানে কাসেদ সকল প্রেরিত হইল। সকলে আবার গমনে অগ্রসর হইলেন। একদিন প্রেরিত গুপ্তচর ও সন্ধানী লোকদিগের সহিত দেখা হইল। সবিস্তার অবগত হইয়া পুনরায় যাইতে লাগিলেন। নির্দিষ্ট স্থান অতি নিকট; উৎসাহে গমনবেগ বৃদ্ধি করা হইল।